দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি সম্ভব হলেও আমদানি করতে হয় যব
মতিনুজ্জামান মিটু : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. নাজিরুল ইসলামের নির্দেশনায় সিএসও মো. আমিরুজ্জামান জানান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্যাসটিকসহ বিভিন্ন রোগ এবং সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে বার্লি বা যবের চাষ সামান্য বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ওটস বা বার্লি বা যব চাষ হচ্ছে। শস্যটি এ দেশে ‘পায়রা’ নামেও পরিচিত।
দেশের আবাদি জমির প্রায় শতকরা ০.১০ ভাগ এলাকা জুড়ে এর চাষ হয়। তবে বোরো ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের চাষ বিস্তার পেয়েছে। এতে বার্লির আবাদ কমছে। উৎপাদন এতোটাই কমেছে যে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ক্রপস উইংও যব বা বার্লির কোনও ডাটা রাখে না বলে জানান, এই উইং এর পরিচালক দিলরুবা আক্তার।
বার্লি রবি মৌসুমের ফসল। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় টাঙ্গাইলে (৪৮০ একর)। এরপরের অবস্থান রয়েছে ঢাকা (৩৬৩ একর) ও পাবনা (৪৯ একর) জেলায়। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ৮৯২ একর জমিতে আবাদ করা হলে ৩২০ মেট্রিক টন বার্লি উৎপাদিত হয় (তথ্যসূত্র: বিবিএস)।
রুটি তৈরি এবং ছাতু হিসেবেও বার্লি খাওয়ার চল রয়েছে। শিশুখাদ্য হিসেবে রবিনসন, ওভালটিন, হরলিকস, হ্যামিলটন ও আলবার্টা বার্লির মূল উপাদান বার্লি বা যব। ওটস একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এর মধ্যে রয়েছে শতকরা ৬১.৮ ভাগ শর্করা, ১৩.১ ভাগ আমিষ, অদ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, আর্দ্রতা ৭.৫৫ শতাংশ, দ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, পেনটোসান ৪.২৮ শতাংশ, লিপিড ২.৯২ শতাংশ, ছাই ১.৮৯ শতাংশ ও অন্যান্য উপাদন শতকরা ৪.২৬ ভাগ।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর জন্য বার্লি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ পথ্য। বার্লির মধ্যে পানিতে দ্রবনীয় আঁশ ও করোনেল রয়েছে। এসব উপাদান রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে। ওটস বা যবে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি রেডিকেল প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে। ওটস এর এন্টি অক্সিডেন্ট খুবই অনন্য। ওটস বা যব বা বার্লির আরেক নাম ‘ওটস মিল’। যা দ্রুত ওজন কমিয়ে কোলেস্টরেল ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ওটস ইংরেজি শব্দ। প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে ধান ও গম পরিবারের অন্তঃর্ভূক্ত এ শস্যটি চাষ করে আসছে। ওটস স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে সমজাতীয় খাদ্য তালিকার প্রায় উপরের দিকে অবস্থান করে। এতে অন্যান্য খাদ্য শস্যের চেয়ে অনেক বেশি পরিমানে দ্রবিভূত আশ জাতীয় অংশ থাকায় এটি তুলনামূলক ধীরে হজম হয়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, এতে রয়েছে অতি উচ্চমাত্রায় সহজে দ্রবনীয় বেটা গ্লুকোন, যা ক্ষতিকর কোলেস্টরল কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। হৃদরোগ কমাতেও সহায়ক। এছাড়াও আরও কিছু কিছু উপকারি উপাদান আছে; যেমন আলফা টোকোটেরিওন, যে উপাদানগুলো এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে, আলজেইমার রোগ গ্লোকোমা এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
জার্নাল অফ দি আমেরিকান কলেজ অফ নিউট্রেশন এর একটি জরিপে বলা হয়েছে; অন্যান্য যেকোনও খাবারের চেয়ে ওটমিল বেশিক্ষণ পেট ভরা রাখে। যারা ওজন কমাতে ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের জন্য প্রতিদিন সকালে একবাটি ওটস বা যব নাশতা হিসেবে খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন খাদ্যশিল্পে বার্লির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদিত বার্লিতে দেশের চাহিদা পূরণ হয় না। এজন্য আমদানি করতে হয়। দেশে বার্লি চাষ বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে রবি মৌসুমে সেখানে অন্যকোনও ফসল হয় না। এসব স্থানে বার্লির আবাদ করা যেতে পারে। কারণ বার্লি যথেষ্ট লবণ সহ্য করতে পারে। আশার কথা, তামাক চাষ বাদ দিয়ে ঐ জমিতে বার্লির আবাদ বিস্তার করা যেতে পারে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনার প্রায় এক লাখ একর জমিতে বার্লি আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে।
অগ্রহায়ণে রোপা আমন ধান কাটার পর এ জমিতে বার্লির আবাদ করা যায়। চৈত্রে বার্লি ফসল কাটার পর ঐ জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা যেতে পারে। আউশ ধানের পর রোপা আমনের আবাদ করা যায়। ফলে বর্তমানে প্রচলিত এক ফসল রোপা আমন ধানের জমি তিন ফসলি জমিতে (বার্লি-আউশ ধান-রোপা আমন ধান) রূপান্তরের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে গমের ফলন ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণভাবে খরা ও উচ্চ তাপমাত্রায় গমের চেয়ে ওট বা বার্লি বা যব বেশি সহনশীল। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে গমের পরিবর্তে বার্লির উপযুক্ত জাত বাছাই পরীক্ষা পরিচালনা করা যেতে পারে। জানা গেছে, খরাপ্রবণ চরাঞ্চলে কিছু স্থানীয় জাতের বার্লির চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সাতটি বার্লির জাত (বারি বার্লি-১ থেকে বারি বার্লি-৭) ছাড় করা হয়েছে।
বার্লি উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশজ চাহিদা পূরণ করে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন- অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ও সৌদি আরবে বার্লি রপ্তানি করা যাবে। বার্লি একটি উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে গণ্য। বার্লির উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।
বার্লি দিয়ে রুটি তৈয়ার হয়। ছাতু, হিসাবে ও বার্লির ব্যবহার চলে আসছে বহুকাল থেকে। শিশু খাদ্য হিসাবেও রবিনসন বার্লি, ওভালটিন, হরলিক্স, হ্যামিলটনবার্লি এবং আলবার্টাবার্লির ও মূল উপাদান বার্লি বা যব। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ইদানীংকালে বৈশ্বিক তাপ মাত্রা বৃদ্ধির ফলে গমের ফলন ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণ ভাবে খরা এবং উচ্চ তাপমাত্রায় পরিবেশে গমের চেয়ে বার্লি বেশী সহনশীল।
বৈশ্বিক তাপ মাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলার জন্য বার্লির তাপ, খরা ও রোগ বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত বাছাই গবেষণা জোরদার করা দরকার। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংগ্রহে ওট বা বার্লি বা যবের ১৮৯টি একসেশন আছে। এ সমৃদ্ধ সংগ্রহ থেকে বাছাই করা কিছু একসেশন নিয়ে কৃষকদের সহযোগিতায় অংশদারিত্ব মূলক জাত বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।