কর্মজীবী নারীদের বড় অংশ গৃহকর্মী শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়নি
মতিনুজ্জামান মিটু : দেশের প্রায় ১৭ লাখ গৃহকর্মীর অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের শ্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকারসহ সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এটি নিশ্চিত করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ বাস্তবায়ন জরুরি। তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আনতে হলে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংগঠন ও অন্যান্য পক্ষগুলোকে এ নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২১ উপলক্ষ্যে সম্প্রতি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের অধিকার ও কল্যাণ: নীতি বাস্তবায়নে সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। গণসাক্ষরতা অভিযান ও অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ এর যৌথ আয়োজনে সিকিউরিং রাইটস ফর উইমেন ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স (সুনীতি) প্রকল্পের আওতায় মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কে. এম. আবদুস সালাম, সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান, শাহীন আকতার ডলি, নির্বাহী পরিচালক, নারী মৈত্রী ও সদস্য, কনসালটেটিভ ফোরাম, সিকিউরিং রাইটস প্রজেক্ট, আবুল হোসাইন, ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী, গৃহকর্মী অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক সহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গৃহকর্মীরা।
সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পিনাস আক্তার, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ সালের শ্রম শক্তি জরিপ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর্মজীবি নারীদের একটি বড় অংশ (১.৬৯ মিলিয়ন মানুষ) গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত যাদের প্রায় ৯০% নারী। এই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তাদের অধিকার এবং শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক নিরীক্ষণ ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত কার্যকর হতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সালে (জানুয়ারী- ডিসেম্বর) মোট ৪৪ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জনের রহস্যজনক মৃত্যুসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন। এছাড়া শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চরমভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১২ জন, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন। এইসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট থানায় একটি করে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে কে এম আবদুস সালাম বলেন, সরকারী পর্যায়ে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ নিয়ে যথেষ্ট কাজ হচ্ছে। বর্তমানে এ বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারের মনিটরিং সেল আছে। নীতিটির আওতায় শিশুশ্রমের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, করোনাকালে সরকার ২৩টি খাতে সহায়তা দিয়েছে এবং তার মধ্যে সর্বপ্রথম হল শ্রমজীবী মানুষের জন্য সহায়তা। তবে গৃহকর্মী সুরক্ষা কল্যাণ নীতিটি বাস্তবায়নে এখনও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। বিষয়টিকে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আনার বিষয়ে তার মন্ত্রণালয় কাজ করে যাবে বলে জানান শ্রম সচিব।
অনুষ্ঠানে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, গৃহকর্মে নিয়োজিত রয়েছে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে এবং আমাদের প্রত্যেকের ঘর থেকেই সেটি আমাদের শুরু করতে হবে। গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ বাস্তবায়নের অবস্থা কি, এটিকে আইনে রূপান্তর করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
শাহীন আকতার ডলি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার কারনে গৃহকর্মীরা স্বীকৃতি পান নি। এ মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। গৃহকর্মের মর্যাদা দিতে হবে। জনগণ ও সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ যদি গৃহশ্রমিককে মর্যাদা দিতে পারে তাহলেই তার মর্যাদার জায়গাটি পরিবর্তন সম্ভব হবে। শ্রমিক হিসেবে শুধু স্বীকৃতি দিলেই হবে না। তাদের শিক্ষার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।
আবুল হোসাইন বলেন, নীতিমালাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন চ্যালেঞ্জ নেই, প্রতিবন্ধকতা রয়েছে নীতিটি বাস্তবায়নের মানসিকতায়। ২০১৫ সালে ট্রেড ইউনিয়নের সুপারিশের ভিত্তিতেই নীতিটি তৈরি হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত এটির কোন বাস্তবায়ন নেই। তবে আমরা নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না।