প্রথম পাতা • লিড ৪ • শেষ পাতা
দেশে ১৫ মোবাইল ব্যাংক
মো. আখতারুজ্জামান : ‘তুমি মোবাইলের দোকান থেকে টাকা নিয়ে আসিও। আমি টাকা পাঠিয়েছি। মেয়ের জন্য ভালো একটা জামা নিও। আমি আগামী মাসে বাড়িতে আসবো।’ কথাগুলো রিকসা চালক মালেক মিয়ার। তার বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জে। সে রাজধানীর মগবাজার রেলগেট এলাকায় নিজের রিকসার উপর বসে কথা বলছিলেন। জানতে চাইল মালেক মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, আগে বাড়িতে টাকা পাঠাতে খুব কষ্ট হতো। টাকা নিয়ে প্রতিসপ্তাহে বাড়িতে যেতে হতো। এখন আর যেতে হয় না। মোবাইলেই টাকা পাঠানো যায়।
শুধু মালেক নন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পেয়ে এমন শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে। যারা ব্যাংকিং সেবা থেকে দূরে রয়েছে বা এই সেবা নিতে পারে না তাদের কথা চিন্তা করে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন প্রতিনিয়ত মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযাই বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সে হিসেবে গত জানুয়ারি মাসে মোবাইলে আর্থিক লেনদেন হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এ তো শুধু দেশের কথা, প্রতিদিন বিদেশ থেকেও মোবাইলে আসছে টাকা। বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে বৈধ উপায়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। বর্তমান দেশে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা বা তারও বেশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিত্যনতুন সেবা যুক্ত করছে সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে ৮টিরও বেশি সেবা দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ জানান, শ্রমজীবী মানুষরা জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন শহরে কাজ করে। আগে তারা গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো নানা ধরনের সমস্যায় পড়ত। তারা পরিচিত লোকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গিয়ে দেখা গেছে পরিবার সঠিক সময়ে টাকা পায় না বা টাকা হারিয়ে ফেলে। সেইসঙ্গে নানা প্রতারণার শিকার হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই বললেই চলে। প্রত্যেকের হাতে এখন মোবাইল। তারা মোবাইলের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠাতে পারছে।
তিনি জানান, শ্রমজীবী মানুষদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে এরা এক সঙ্গে অনেক টাকা আয় করতে পারে না। তাই তাদের পরিবারের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। আগে টাকা পাঠাতে দিন পর দিন লাগত। এখন দ্রুত টাকা পাঠাতে পারায় তারা পরিবারের সদস্যদের জীবন মান অনেকে উন্নত হয়েছে। এখন তাদের যখন মন চাচ্ছে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। প্রতারণার ঝুঁকি নেই। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনেকে কিছুই করা হচ্ছে। গার্মেন্টস মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিচ্ছে। আগে এই বেতন-বোনাসের সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যেত না। এখন এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য থেকে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, করোনাকালীন মোবাইল ব্যাংকিং অনেকে ভূমিকা রেখেছে। করোনায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার দুস্থ পরিবারগুলোকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা এই মাধ্যমেই করেছে। তবে পর্যায়ক্রমে সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের দেয়া সব ধরনের আর্থিক সহযোগিতার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেবে। এতে করে সরকারি সহায়তা দেয়া নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সেটা অনেকটা বন্ধ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সহায়তা এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। আর এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আগে এই টাকা বিতরণ নিয়ে যে ঝামেলায় পড়ত এখন সেটা নেই। এটাও আমাদের জীবনমান উন্নয়নেরই অংশ।
নাজনীন আহমেদ জানান, মোবাইল ব্যাংকিং দেশের উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করেছে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার কাজেও এই মাধ্যমকে ব্যবহার করছে। তারা অনলাইন বা অন্য কোনো মাধ্যমে তাদের পণ্যের অর্ডার দিচ্ছে। সেইসঙ্গে তারা তাদের দেনা-পাওনা খুব সহজেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করছে।
মোবাইল ব্যাংকিংকে আরও সহজ করতে বিশেষ উদ্যোগের কথা জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন, ২০২১ সালের মধ্যেই আন্তঃমোবাইল ব্যাংকিং অর্থাৎ এক মোবাইল ব্যাংকিং থেকে অন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করা হবে।
জানা যায়, ২০১১ সালের মার্চে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথমবারের মতো দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। দেশের সরকারি-বেসরকারি ৫৮ ব্যাংকের মধ্যে ২৮টি ব্যাংককে এই সেবা চালুর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগিতার বাজার টিকতে না পেরে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা ব্যাংকের সংখ্যা ১৫টিতে নেমে এসেছে। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও