সাত মার্চের ভাষণ লেলিহান আগুন
প্রবীর বিকাশ সরকার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অগ্নিজ্বলা ভাষণটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণও বটে। এই ভাষণটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোর মধ্যেও শ্রেষ্ঠ তা বলাই বাহুল্য। শুধু এশিয়া মহাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বে এরকম একটি ভাষণের তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে ভাষণটি আবালবৃদ্ধবনিতা তথা ৭ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে অতিদ্রæত প্রভাব বিস্তার করেছিল। এইরকম নজির বিশ্বের ইতিহাসে তেমন নেই বললেই চলে। এই বিরলতার কারণেই জাতিসংঘের ইউনেসকো সংস্থা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর অন্যতম বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এই জন্য বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত ও ধন্য। বঙ্গবন্ধুর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি যখন শুনি, তখন আমি মাত্র ১২ বছরের এক কিশোর। পরিবারের সকলের মতো আমিও সেদিন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুনেছি। তখন অতো রাজনীতি বুঝিনি, কিন্তু ভাষণটির শেষদিকে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এই কথাগুলো শুনে আমি যুগপৎ দারুণ অভিভ‚ত এবং উদীপ্ত হয়েছিলাম কী জানি কেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা শহরের হিন্দুদের মতো আমরা ভারতে পালিয়ে যাইনি, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে শহরেই ছিলাম। স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয় কুমিল্লা শহরেই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একাত্তর সালের ৮ ডিসেম্বর তারিখে। কিন্তু পুরো নয়টি মাসব্যাপী বুকের ভেতরে সবসময় অনুরণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ওই কথাগুলো। মাঝেমাঝে মনে হতো, এই যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এর জন্যই বঙ্গবন্ধু সেদিন ভাষণটি দিয়েছিলেন। পুরো ভাষণের মূল কথাগুলোই ছিল, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। সংগ্রামটা এখন যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তিনি সেদিন সরাসরি ‘যুদ্ধের’ কথা বলেননি, কিন্তু সংগ্রাম কথাটির মধ্যে যুদ্ধের কথাই ছিল এবং এই কারণেই বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য। আর এই ভাষণেই শাসক-শোষক পাকিস্তানিরা তাদের ঘরে এক ‘লেলিহান আগুন’ জ্বলে ওঠার আভাস পেয়েছিল ভালোভাবেই। তাই তারা ২৫ মার্চ গভীর রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো নিরপরাধ বাঙালিকে নিধনের মাধ্যমে সেই ‘লেলিহান আগুন’ নেভানোর অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু নেভাতে পারেনি। পারবেও না কোনোদিন। তার কারণ হিসেবে দুটি ঘটনার কথা বলব : [১] আমি যখন জাপানে আগমন করি বিদেশি ছাত্র হিসেবে ১৯৮৪ সালে। তখন বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি উচ্চশিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযোদ্ধা আগেই থেকেই বসবাস করছেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কোনো সভা-সমিতিতে তাদের কাউকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি মুখে নিতে শুনিনি! সে এক তাজ্জব ব্যাপার হিসেবে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের শেষদিকে যখন বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার জন্য আমি উদ্যোগ গ্রহণ করি তখন অনেক তরুণ আওয়ামী লীগ সমর্থক ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারীকে খুঁজে পাই। বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করি। সেইসময় আমি প্রিয় গানের অনেকগুলো ক্যাসেট সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে একটিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রেকর্ড করা ছিল যা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমাঝে শুনতাম। বিশেষ করে, ৭ মার্চসহ জাতীয় দিবসগুলোতে। আলাওল হল আবাসিক ছাত্রবাসের বাসিন্দা হিসেবে ক্যাসেট রেকর্ডারে সম্পূর্ণ ভলিয়মে ভাষণটি বাজাতাম সারাদিনই। তখন খেয়াল করতাম, বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্ররা দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতো। আমরা একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত চিহ্নিত ‘পাকিস্তানপন্থী’দের অবস্থা দেখার জন্য টহল দিতাম। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, তাদের ঘায়েল করা এবং মরমে মারার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি একটি মহাহাতিয়ার। যা আণবিক বোমার মতো। যাহোক, বঙ্গবন্ধুর পরিষদ গঠন করার সময় প্রস্তুতি সভাগুলোতে আমরা প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুনতাম। তখন কী যে একটা আবেগ সারামন ও শরীরের রক্তকে উষ্ণ করে তুলত তার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়! আমরা দারুণ উজ্জীবিত হয়ে উঠতাম। বঙ্গবন্ধুহত্যাকাÐের বিচারের জন্য সোচ্চার হতাম, দূতাবাসে কর্মরত বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রাশেদ চৌধুরীকে দূতাবাস থেকে অপসারণের দাবি তুলতাম, বঙ্গবন্ধুহত্যাকাÐের বিচার চেয়ে দূতাবাসে স্মারক লিপি দিতাম। তখন এরশাদ আমলের শেষসময়। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রবাসের মাটিতে সবসময় প্রচÐ দেশাত্ববোধ এবং সাহসের আগুন জ্বালিয়ে রাখত। এখনো এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। এখনো ৭ মার্চের ভাষণ যখন শুনি এই প্রবাসে তখন বঙ্গবন্ধুকে অশ্রæজলে ভেসে গিয়ে এমনভাবে অনুভব করি, যার কোনো ভাষা নেই।
[২] বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা গঠনের প্রস্তুতি পর্বে আমরা কয়েকবার আলাপে বসেছিলাম তৎকালীন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী ও নাট্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ দুলালের সঙ্গে। তিনি যতো বছর জাপানে ছিলেন, ততোবারই ৭ মার্চ সকালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফোন করে ভাষণটি ক্যাসেট রেকর্ডারে চালিয়ে দিতেন। সেই সময় রাশেদ চৌধুরীর মানসিক অবস্থাটা বুঝতে আমাদের কষ্ট হতো না। এরপর রাশেদ চৌধুরীর ভাত জাপানে ফুরিয়ে এসেছিল। পাত্তারি গুটিয়ে ভিন্ন দেশে যেতে বাধ্য হয়েছিল নিরপরাধ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরাই শুধু নয়, বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা যেখানেই থাকুক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বুলেটছোঁড়া ভাষণটি তাদের পিছু হঠাতে বাধ্য করবে, লেলিহান আগুনের মতো বারবার দাউ দাউ জ্বালা ধরাবে বুকের মধ্যে। এই ভাষণ থেকে তাদের নিস্তার নেই। বংশ পরম্পরায় তাদেরকে জ্বলতে হবে এই অনলবর্ষী ভাষণের আগুনে। ভাষণটি যত প্রচারিত হবে ততোই বাঙালির মধ্যে দেশাত্ববোধ ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখক : রবীন্দ্রগবেষক ও কথাসাহিক্যিক