আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ২
পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণে সেতু রচনা করে বৈশি^ক কেন্দ্রবিন্দুতে শেখ হাসিনা
তরিকুল ইসলাম : বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবর্ষের বৈশি^ক কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় সরব আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা। বিশেষ করে ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রাখাইন পরিস্থিতির অবনতি ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার নতুন মাত্রায় যুক্ত হয়েছেন তিনি। দেশে দেশে ও জাতিসংঘসহ বৈশি^ক প্লাটফর্মে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা কূটনীতির জোরালো অবস্থানের শুরুর দিক থেকে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সেতু রচনায় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন শেখ হাসিনা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে নতুন করে দুই ক্যারিবীয় দ্বীপ রাষ্ট্র সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস এবং কমনওয়েলথ অব ডোমেনিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে দুই দেশের সঙ্গে যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া অনুসমর্থনের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি, অর্গানাইজেশন অব ক্যারিবিয়ান স্টেটসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য। দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা পাওয়া যাবে।
বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন দেশে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রয়েছে- ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দপ্তর, জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায়, ব্রাসেলসে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদর দপ্তর ও প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশে আরো পাঁচটি বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজে বঙ্গবন্ধু সেন্টার স্থাপন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব লর্ডসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন এবং ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এ রকম গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।
লন্ডনে মাদাম তুসো জাদুঘর এবং জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য স্থাপন এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও আদর্শভিত্তিক চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের মুজিব ফেলোশিপ অ্যান্ড ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পিস-কিপিং সাফল্যকে উদযাপন করা হবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনারের অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্রের ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী। ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও শিলংয়ে নাগরিক মিলনমেলার আয়োজন থাকবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্বের সব দেশে রোপণ করা হবে ১০০টি করে গাছের চারা। যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার এবং আগামী মে মাসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটে ‘শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত্রী ও মুজিবর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্চেই পাঁচ বিশ^ নেতার ঢাকা সফরের কথা জানলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া) রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি বুঝে বিশ^ নেতাদের ঢাকা সফর সাজানো হচ্ছে ভিন-ভিন্নœ ফর্মে। যে সকল সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি আসতে পারবেন না তাদের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিতে করছে ঢাকা।
বছরব্যাপী অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট হুন সেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা, পোপ ফ্রান্সিস, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মেদ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানসহ বিভিন্ন নেতা বক্তব্য দিতে বা ঢাকা সফর করতে পারেন।
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইবরাহিম মোহামেদ সলিহ ১৭-১৮ মার্চ ঢাকা সফর করবেন। নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি ২২-২৩ মার্চ ঢাকা সফর করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৬-২৭ মার্চ ঢাকা সফর করবেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ১৯ থেকে ২০ মার্চ ঢাকা সফর করবেন। ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক মার্চেই ঢাকা সফর আসছেন। তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির রাষ্ট্রপ্রধানও এ সময়ের মধ্যে ঢাকা সফেরের কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ এখনও নিয়ন্ত্রণে না আসায় শেষ পর্যন্ত তাদের সফর নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবও এরসঙ্গে যোগ হয়েছে এ বছর। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা ঢাকা সফরে তেজগাঁও প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারক বৃক্ততা করবেন। বঙ্গন্ধু-বাংলাদেশ ও বিশ^ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে সিরিজ লেকচারে অংশ নেবেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সম্পর্কিত সেলের তথ্য মতে, ১৭ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে বিক্তব্য দেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এ অনুষ্ঠান চীনের টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভিডিও বক্তব্য ১৭ থেকে ২৬ মার্চ প্রকাশ পাবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও ভার্চুয়ালি সম্প্রচারের আয়োজন এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।
বিশ^ নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। এ আয়োজনকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে এ নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ আয়োজনে বিদেশে পালিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত্রী।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে নেপালের রাষ্ট্রপতির বৈঠক হবে। এছাড়া মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি, ভারত ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হবে। বাংলাদেশের মতো নেপালের রাষ্ট্রপতির সেরিমোনিয়াল পদ হওয়ায় দুই রাষ্ট্রপতির মধ্যে বৈঠক হবে। বাকিরা নির্বাহী প্রধান হওয়ায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের বৈঠক হবে। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরে ঢাকার কূটনীতিকরা চাচ্ছেন, ভারতের শীর্ষ প্রধানের ঢাকা সফরে কমপক্ষে ছয়টি বিষয়ে সমাঝোতা স্মারক বা চুক্তি করতে; যার মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কুশিয়ারা নদীতে পানি উন্নয়ন অধিক গুরুত্ব পাবে। এছাড়া বাণিজ্য, বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যে স্থল যান চলাচল, জ্বালানি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র-সম্পদ প্রাধান্য পাবে। অন্যদিকে, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির সফরে মৎস্য খাতের সহযোগিতা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমাঝোতা স্মারক সই হবে বলে জানা গেছে। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও