গুগলের টেকনিক্যাল প্রোডাক্ট ম্যানেজার বাংলাদেশি প্রযুক্তিবিদ শিশির খান
দেবদুলাল মুন্না : সানফ্রান্সেসকোর সিলিকন ভ্যালির বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও রয়েছেন বিপুল সংখ্যক মেধাবী বাঙালি। বিশ্ববিখ্যাত অনলাইন সার্চ ইঞ্জিন গুগলে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন বাঙালি প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু সবার আগে একজন সফল বাংলাদেশী প্রযুক্তিবিদ হিসেবে শিশির খান এখানে যোগ দেন। সিলিকন ভ্যালিতে অন্যান্য আইটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশাল একটি এলাকা জুড়ে গুগলপ্লেক্স। প্রবেশ পথেই সারি সারি পাম গাছ। তার মাঝখান দিয়ে সামনে এগুলেই ইস্পাত আর কাঁচে ঘেরা অনেকগুলো বিল্ডিং। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি। ক্যাম্পাসের ভবনগুলোর মাঝে গুগল রঙে রাঙানো বর্ণিল বাইসাইকেল। গুগলার এবং পর্যটকদের সুবিধার্থে এ ব্যবস্থা। ভয়েস অব আমেরিকা সম্প্রতি সম্প্রতি শিশিরের কর্ম ও জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র করেছে।
এ ডকু ড্রামায় জানা যায়, এরকম বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে যোগ দেওয়ার আগে শিশির টাকা রোজগারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় ট্যাক্সি ক্যাব চালিয়েছেন রাতের পর রাত। দিনে পড়াশোনা করতেন। ফাঁকে ফাঁকে চাকরি খুঁজতেন। বর্তমানে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি গুগলে কাজ করলেও বিশ্বখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানে ২০০৪ সালের আগে কোনো বাংলাদেশির পদচারণ ছিল না। সে বছরই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় গুগলের প্রধান কার্যালয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলী পদে যোগ দেন মোহাম্মাদ শিশির খান। তিনি এখন গুগলের কারিগরি পণ্য ব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল প্রোডাক্ট ম্যানেজার)।
সিরাজগঞ্জের ছেলে শিশির ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা শেষে স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। সেখানে দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শেষে প্রথমে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি ও পরে ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে স্নাতক হন। পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজনেরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় বাংলাদেশে খুব একটা আসা না হলেও দেশকে নিয়ে সব সময় ভাবেন, দেশের সব খবর রাখেন। বললেন, ‘বাংলাদেশের প্রযুক্তি জগৎ যেন শক্তিশালী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য গুগলে আমরা বাংলাদেশিরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। গুগলের সব সেবা বাংলায় রূপান্তর করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গুগলের নানা কার্যক্রম চালু হয়েছে। গুগল বাসের মাধ্যমে আমরা প্রায় সাড়ে তিন শ’ স্কুল-কলেজের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীকে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’ এ কাজে গুগলকে সহায়তা করছে অনেকগুলো সংগঠন। শিশির খান ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, আবেদনের সময় আমি জানতাম না যে এটা গুগল। মিশিগান স্টেটটা মূলত গাড়ির জন্য বিখ্যাত। তাই আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসি। সফটওয়্যার প্রকৌশলীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেছিলাম। সে সময় গুগলে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছাড়া কাউকে নিত না। আমার সাক্ষাৎকারটা খুব ভালো হয়েছিল বলে আমি স্নাতক হয়েও সুযোগ পেয়েছিলাম। এক হাজার জনের সেই প্রতিষ্ঠানে এখন একেকটা দলেই হাজার জনের বেশি লোক কাজ করছেন। আমার কাজটা মূলত পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো পণ্যের বাস্তবায়ন করা। গুগলে কাজটা বেশ আনন্দদায়ক। সবাই মিলে একটা ঘরে ধারণা ভাগাভাগি করে কাজ করি আমরা। দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করলাম কি না, সেটাই বড় কথা। ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই।
শিশির খান জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। প্রযুক্তির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আগের চেয়ে বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ, যারা ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠছে। গুগলে চাকরি অনেকের কাছেই অনেকটা স্বপ্নের মতো। তবে নিয়োগ পদ্ধতিটা সময়সাপেক্ষ। অনেক স্তর পেরিয়ে তবেই ঠিক হয়, কে সুযোগ পাবে। সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগে তুলনামূলক ঝামেলা কম। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে বেশি সুযোগ পেলেও যেকোনো বিভাগের শিক্ষার্থী আবেদন করতে পারেন। শিশির খান বলেন, প্রোগ্রামিংটা আসলে একটা ভাষার ব্যাকরণের মতো। সেই ব্যাকরণ, সেই অ্যালগরিদমটা কে কত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারছে, সেটা দেখা হয়। সমস্যা সমাধান করতে পারছে কি না, সেটাই মুখ্য।
ব্যক্তিগত জীবনে কিছুদিন আগে শাহরিন রেজার সঙ্গে সংসার পেতেছেন শিশির। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমফিল করলেও দেশের মানুষকে আর্সেনিক দূষণ থেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন শাহরিন। চালু করেছেন পিউরিফএইড নামের প্রতিষ্ঠান। শিশির জানান, গুগলে প্রথম যারা কাজে ঢোকেন তাদেরকে বলা হয় গুগলার হতে হলে প্রথম চার সপ্তাহে ১৫ পাউন্ড ওজন বাড়াতে হবে। এতো খাবার থাকে বিভিন্ন ক্যাফেতে। নানা ধরনের কফি, রেগুলার খাবার। যানবাহনের ব্যবস্থা আছে। ফ্রি গাড়ি এক্সারসাইজ, ইন্ডিয়ান ড্যান্স, ইয়োগা, ভারতনাট্যম। কাজের বিষাদ কমাতে ম্যাসেজ, যোগ ব্যায়াম করে ইনার স্ট্রেসম কমানো হয়। চুল কাটা, বাইক ফিক্স, চাকু ধার। গুগলের বিশাল ক্যাম্পাস সবার জন্য উন্মুক্ত। পায়ে হেঁটে বা নিজের গাড়িতে করে আপন মনে যে কেউ ঘুরে দেখতে পারে। প্রাত্যহিক জীবনের ভার্চুয়াল জগতে, তথ্য পেতে যাকে ছাড়া চলে না সে হচ্ছে গুগল।
সারা ক্যাম্পাসে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণী। গুগলারদের সজীব আর সৃষ্টিশীল রাখার নানা আয়োজন। বিচ ভলিবল, সুইমিং পুল, ইত্যাদি। শিশির খান জানান, গুগল শুরুর ইতিহাস। ১৯৯৮ সালে কিভাবে প্রথম গুগল শুরু হয় পল আল্টোর একটি গ্যারাজে সে ইতিহাস বললেন তিনি। বলেন, প্রথম গুগল- ১৯৯৮ এ শুরু হয় পল আল্টোর গ্যারাজে। পরে এ চারটি ভবন দিয়ে যাত্রা বড় আকারে। গোটা গুগল ক্যাম্পাসে ঘুরলে চোখে পড়ে গুগলের চারটি প্রাইমারি কালার। হলুদ লাল সবুজ নীল। সবাই ইনফরমাল ড্রেসে চলাফেরা করে।
শিশির বলেন, আমি এখন কাজ করছি সার্চ অ্যাড মেশিন লার্নিং গুগল ব্রেইন বা নেচারাল ল্যাংগুয়েজ আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে। আপনি বাংলায় বলবেন আমি ইংরেজি বা যে কোনো ভাষায় কথা বলি- একজন আরেকজনকে তা বুঝতে পারবে। ইনস্ট্যান্ট ট্রান্সলেশন। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও