আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ২
বাংলাদেশে বিনিয়োগের এখনই সুবর্ণ সময় : বিএসইসি চেয়ারম্যান
বিশ^জিৎ দত্ত : দেশের অর্থনীতিতে রিজার্ভের ব্যবহার, পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ, ৬টি বড় কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসা, কর কাঠামোর সংস্কার ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকের চলমান দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম।
গত শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ইআরএফ ডায়ালগ অন বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমি’ শীর্ষক এক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি অনুষ্ঠানে বলেন, কারসাজি করে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো পুঁজিবাজারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ পুঁজিবাজারে অনেক সংস্কার করা হয়েছে। এর আধুনিকায়ণও হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাবে। তখন আমরা ‘শ্যালো ক্যাপিটাল মার্কেট’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।’
এসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে কোথাও বিনিয়োগ সম্ভব নয়। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে হলে বন্ডের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।’ তিনি বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলারে উন্নীত হবে। রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এটি যদি না করতে পারি, একসময় এ রিজার্ভের টাকা আমাদের জন্য দায়বদ্ধতা (লায়াবিলিটি) তৈরি করবে।’
দেশের ছয়টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানান বিএসইসির চেয়ারম্যান। যার মধ্যে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানও আছে, যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক টার্নওভার ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে আয়করের ভিত্তিতে বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশের ২৩ টি প্রধান বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা দিয়েছিল। যাদের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ১০০ কোটি ডলারের।
শেয়ারবাজারে দুর্বল কোম্পানি আনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার দুটি চোখ সামনে। পেছনে যা হয়েছে, সেখানে যদি সময় দিই, তাহলে সামনে এগোতে পারব না।’
ভালো কোম্পানি কেন পুঁজিবাজারে আসে না সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের তো ঋণ করতে হয় না। চাইলেই তারা বিদেশি সংস্থা থেকে ২ শতাংশ দিয়ে ঋণ পেয়ে যাচ্ছে। তাই তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হয় না। তা ছাড়া বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করের ব্যবধান মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। এ ব্যবধান কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আগামী বাজেটে এ দুই খাতে করের ব্যবধান ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে না আসার কারণ হিসেবে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, এখানে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আছে। কোম্পানির বোর্ডে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেখানে অভিজ্ঞ মানুষের খুব অভাব আছে।
পদ্মা ব্যাংক থেকে টাকা সরানো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত ও সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সংলাপে। তখন তিনি বলেন, ‘আমরা পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের চিঠি পেয়েছি। আমরা ব্যাংকের কথাও শুনব। আমরা দুই পক্ষের বক্তব্যই পর্যালোচনা করব। দেশের বিদ্যমান আইনে যা বলা আছে, তা-ই প্রয়োগ করা হবে। এতটুকু বিচ্যুত হব না আমরা।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের বাজেটের আকার ৫ লাখ কোটি টাকা। অথচ প্রতিবছর আমাদের দেশে আইপিওর মাধ্যমে মাত্র এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা তোলা হয়। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দেশে শিল্পায়ন হতে হলে পুঁজিবাজার থেকে টাকা ওঠানোর পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে আমাদের পুঁজিবাজার। বড় কিছু সংস্কার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারে। চালু হতে যাচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে ইমার্জিং মার্কেটে উন্নীত হতে পারে।’
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কমিশন নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে নতুন কিছু ট্রেক ইস্যু করা হবে। এক বছরের মধ্যে সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি, স্মল ক্যাপ বোর্ড ও অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড কার্যক্রম শুরু করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পরিচিতি বাড়ানো ও ভাবমূর্তি উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
বিএসইসির চেয়ারম্যান জানান, আগামী জুনে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে একটি রোড শোর আয়োজন করবে ক্রেডিট অ্যাগ্রো সুইস।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটা শক্ত অবস্থানে আছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের আশপাশে শক্ত-সমর্থ বেশকিছু দেশ পেয়েছি, যাদের মাধ্যমে আমরা ভালো ফল পেতে পারি। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অনেক ভালো করা সম্ভব। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশের পুঁজিবাজারের মূলধন সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছিল। বর্তমানে এটি ৫ লাখ কোটি টাকার আশপাশে অবস্থান করছে।’ চলতি বছরের মধ্যে এটি আরো অনেক বেড়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একেকটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক চিত্র একেক রকম। তাই সবার জন্য একই সীমা নীর্ধারণ করে দেয়া উচিত নয়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে জোরালো সমন্বয় দরকার।’ এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বিএসইসির সঙ্গে বৈঠক করবে বলে জানান তিনি।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষা প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা বাড়াতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। এর অংশ হিসেবে আইসিএবির সঙ্গে বিএসইসি ও এফআরসি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সই করবে। ফলে আইসিএবিতে থাকা একটি কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন যেকোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরীক্ষা করতে পারবে। ফলে একটি কোম্পানি ব্যাংকের জন্য এক রকম, এনবিআরের জন্য অন্য রকম ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আরেক রকম আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে না।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগের সময় এখনই উল্লেখ করে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশ যে গতিতে এগুচ্ছে, তাতে ৩০ বছর পর আমাদের আর বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে না। তখন আমরাই বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারব। এরই মধ্যে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে।’ সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও