জনকের জন্মশতবছর, জাতির নিরন্তর শ্রদ্ধা
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবছর উদ্যাপনের কর্মসূচি গৃহীত হয়, কিন্তু করোনার কারণে আনুষ্ঠানিকতা সীমিত করতে হয়। এ বছর ১০১তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু তাকেই নয়, তার মহান কীর্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপনসহ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার মাধ্যমে আগামী দিনের বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করবো, তাহলেই স্বাধীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হতে পারে। গোপালগঞ্জে অজপাড়া গায়ের খোকা, কালে কালে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠবেনÑ এটি হয়তো অনেকরেই ধারণা ছিলো না। কিন্তু ইতিহাস সবসময় নানা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এমন বিস্ময়ের জলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছিলেন, বিদ্যালয়ে পড়াকালেই তার সাহস-সহমর্মিতা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেন। এমনকি তার বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে এসে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা শেরা-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শহীদ সোহ্রাওর্দীর দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হন। তার এই দৃষ্টি কাড়ার গুণ ক্রমইে অন্যদের মধ্যেও প্রসারিত হতে থাকে। গোপালগঞ্জ ছেড়ে উচ্চশিক্ষা নিতে কলকতায় পাড়ি দেওয়া তরুণ শেখ মুজিব লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ এবং জাতির স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। কলকাতার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও তিনি দৃষ্টি কেড়ে নেন। রাজনীতি তিনি শুধু ¯েøাগান ও নেতাদের অন্ধ অনুসারী হয়ে শিখেননি, পড়াশোনা এবং দেশ-বিদেশি রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম এবং মতাদর্শেরে অবস্থান নির্ণয় করতে শেখেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের একজন একনিষ্ট কর্মী হয়ে ওঠেন। কলকাতায় স্বাধীনতার সেই আন্দোলন-সংগ্রামে নানা উত্থান-জঞ্ঝা, বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে তাকে হতবাক হতে হয়। রাজনীতিতে, বিভাজন, দলাদলি, সাম্প্রদায়িকতা তাকে মর্মাহত করে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে রক্তাক্ত পরিস্থিতি দেখে বিপর্যস্ত মন নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশের রাজধানী, বাংলার এই বিভক্তি তাকে পীড়িত করে। বিশেষত পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাষাকেন্দ্রিক বিভাজনের রাজনীতি শুরু করে তা থেকে তার স্বীয় চিন্তা ধারা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়া। তিনি তখন পূর্ব-বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন অধিকারের লড়াইয়ে আপোসহীনভাবে কাজ করতে থাকেন, গড়ে তোলেন রাজনৈতিক সংগঠন, যা পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য-অধিকার আদায়ের প্রয়োজন ছিলো। আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার তাকে কারা বরণ করতে হয়। যতো তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন, ততো তিনি আরও বেশি পূর্ব-বাংলার জনগণের মুক্তির পথের সন্ধান নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়েছিলেন। মুক্ত মুজিব অনেক বেশি সাহসী, ত্যাগী, সফল সংগঠক এবং ভিশনারি- মিশনারি নেতা রূপে আবিভর্‚ত হয়েছেন। অনেক নেতাই তখন পথ হারিয়েছিলেন কিংবা বিদায় নিয়ে ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে মুজিব বাংলা ও বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত নেতা কর্মীদের দৃঢ়-প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রদানের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। সেই চ্যালেঞ্জে মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেকের জীবনে ঘটেছিলো, কারাবরণ করতে হয়েছিলো হাজার হাজার নেতাকর্মীকে, এর প্রতিক্রিয়া সংগঠিত হয় গণঅভ‚্যত্থান। কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন মুজিব, পাকিস্তান মুজিবের কাছে পরাজিত হয়। মুজিব তখন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে বাঙালির কাছে গড়িত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচেনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে তিনি ৬ দফা থেকে স্বাধীনতার একদফায় বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ্য করেন। পকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কামান-বন্দুক দিয়ে তা ভাঙতে চেয়েছিলো। বাঙালি এবং এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো ইস্পাত -কঠিন ঐক্য গঠনের মাধ্যমে মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মুক্তি যুদ্ধ সফল হয়, বাংলাদেশের অভ‚্যদয় ঘঠে।
রাজনীতির এই অমর কৃতি শেখ মুজিবুর রহমানের সাহস, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম এবং অতুলনীয় রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। তিনি একটি শোষনহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করার জন্য কারাগার থেকে দেশে ফিরে এসে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ কখনো দাঁড়াতে পারবে, এটি কেউ ভাবতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ হত দরিদ্র দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নিত হয়। তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে পুরনো রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসন কাঠামো, উৎপাদন ব্যবস্থা, বন্টন, অর্থনৈতিক মুক্তি, শিক্ষা-সাংস্কৃতি উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ-বিদেশি ষড়যন্তকারীরা এমন বাংলাদেশ পছন্দ করেনি। তাই, হত্যা- ক্যু’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই আঘাত করে ছিলো। দীর্ঘদিন সামরিক, আধা-সামরিক ও তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের শাসনে থাকার কারণে পিছিয়ে পড়েছিলো, তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অভ‚তপূর্ব সাফল্য দেখাতে পেরেছেন। পরিবর্তিত বাস্তবতার মধ্যেও শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় তথা উন্নয়শীল দেশে উন্নীত করার সাফল্য দেখাচ্ছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ গড়ার কাজ এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন তার সোনার বাংলা ও সোনার মানুষ গড়ার কাজ সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবছর এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এই চিন্তায় হোক আমাদের আগামী দিনের বাস্তবায়নের লক্ষ্য। লেখক : শিক্ষাবিদ। অনুলিখন : আব্দুল্লাহ মামুন