আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
হাইকোর্টের নিদের্শনা পেলে ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংয়ের অ্যাকাউন্টে কিস্তির টাকা জমা দেওয়ার হার বাড়ছে
মো. আখতারুজ্জামান : অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের বিষয়টি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। ঋণখেলাপিদের ডেকে তাদের দেনার অর্থ কিস্তি আকারে পরিশোধের নিদের্শনা দিয়েছে আদালত। যদিও ২৮০ জনের মধ্যে মাত্র ৮৭ জন উপস্থিত ছিলেন। এতে করে কিস্তি পরিশোধের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, পিপলস লিজিংয়ে ঋণের নামে এক হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার প্রায় পুরোটাই খেলাপিঋণ। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান-একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্টের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এরই ঋণের মধ্যে মেয়াদি আমানত ৯৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, লিজ অর্থায়ন ১০৮ কোটি ৪ লাখ, আবাসন ঋণ ৩৩ কোটি, বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ ২৬ কোটি এবং অন্যান্য সম্পদ ৬৭৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি ৪১৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে।
পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান খান জানান, আমরা হাইকোর্টের নিদের্শনার অপেক্ষায় আছি। তবে নিদের্শনা কিভাবে আসে সেটার উপর নির্ভর করবে আমাদের পরিবর্তিক কার্যক্রম কি হবে। ফলে আমরা এখন দেনা পাওনার বিষয়ে কোনো কিছুই করতে পারছি না। আমি ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন নগদ অর্থ ছিলো মাত্র দেড় কোটি টাকা ছিলো। বর্তমানে ২৫ কোটি টাকা নগদ অর্থ রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ের অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিলে প্রতিমাসে ব্যয় হয় ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা। বর্তমানে ২০ জন বিশেষ নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারি রয়েছেন। আগে থেকেই কিছু ঋণ গ্রহিতা তাদের ঋণের কিস্তির টাকা দিয়ে আসছিলেন। যা এখনও চলমান রয়েছে। তবে হাইকোর্টে ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা পর কিছুটা গতি পেয়েছে। একনাবিনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশকিছু প্রভাবশালীর নাম উঠে এসেছে। একই ব্যক্তি বারবার ঋণের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ইতিমধ্যে পুরো প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২৮০ জন ঋণখেলাপিকে তলব করেছেন উচ্চ আদালত।
পিপলস লিজিংয়ের ১২২ ঋণ খেলাপি ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে হাই কোর্ট। গত ৯ মার্চ এ আদেশ দেয়া হয়। আদালতের নির্দেশের পরও এই ১২২ ঋণ খেলাপি ব্যক্তি বা সত্তা নির্ধারিত তারিখে হাই কোর্টের হাজির হননি। আদালত বলেছে, পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সতর্ক এবং সজাগ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হল। পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবাসায়ক মো. আসাদুজ্জামানকে ওই ১২২ ব্যক্তি বা সত্তার বর্তমান ঠিকানা সরবরাহ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে বলা হয়েছে তাকে। বিডিনিউজ।
পিপলস লিজিংয়ের অনিয়মের সঙ্গে পরিচালক বিশ্বজিৎ কুমার রায়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, আরেফিন শামসুল আলামিন, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোয়াজ্জেম হোসেন, মতিউর রহমান, কবির উদ্দিন মিয়া ও সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বেশি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, পরিচালকরা বোর্ড মিটিংয়ের সম্মানি হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জানা যায়, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া জমি, হোটেল, বাড়ি সমমূল্য আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকাসহ মোট ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা জব্দ করে দুদক। পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের সরাসরি সম্পৃক্ততায় পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে জালিয়াতি হয়েছে। অধিকাংশ ঋণেই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা বিভিন্নভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে নিজের অথবা তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে, ব্যাংক গ্যারান্টি এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে এ ঋণ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন।
জানা যায়, পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান খানের দেয়া এ সংক্রান্ত তালিকা থেকে হাইকোর্ট গত ২১ জানুয়ারিতে মোট ২৮০ জনকে তলব করে। এর মধ্যে ১৪৩ জন ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও ওই দিন ৫১ জন উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে বাকি ১৩৭ জনের উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও ওই দিন আদালতে ৩৬ জন উপস্থিত হন। দুই দফায় মোট ২৮০ জন উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৮৭ জন উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে গত বৃহস্পতিবার পিপলস লিজিংয়ের ২৮০ ঋণ খেলাপির মধ্যে আদালতের তলবের পরেও যারা উপস্থিত হননি তাদের এনআইডি কার্ড যাচাই করে বর্তমান ঠিকানা জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঠিকানা হাতে পাওয়ার পরে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা বিষয়ে আদেশ দেবেন আদালত।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে আবেদন অনুমোদন করলে ১০ জুলাই পিপলসের অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
একই বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা তোলার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। এর একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। আর এর পেছনে ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার।