
ছোট ছোট বিশেষায়িত পোশাক কারখানা সময়ের দাবি

মো. আখতারুজ্জামান : কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে এককখাত হিসেবে শীর্ষে রয়েছে দেশের পোশাকখাত। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পোশাকখাত। এ ব্যবসার নানা দিক নিয়ে আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে কথা বলেছেন নবীন ব্যবসায়ী ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল। করোনাকালীন পোশাকখাতের ক্রয় বিক্রয়ে বর্তমান বেশ পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছে গার্মেন্টস খাত অনলাইন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনাকালীন অনলাইন নির্ভরতা বেড়ে গেছে। এখন প্রায় সবকিছুই হয় অনলাইন ভিত্তিক। ক্রেতার কাছে পণ্যের মান উপস্থাপন। পণ্য ক্রয়সহ অনেক কিছুই হচ্ছে অনলাইনে। বায়িং হাউজগুলোতে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে স্যাম্পল নিয়ে যেতেন। এখন পণ্যের ছবি তুলে তা অনলাইনে পাঠাচ্ছেন।
তিনি বলেন, একটি ইন্ডাস্ট্রিখাত ভালো করতে হলে একটা ব্যালেন্সিং ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন হয়। এখানে বড়রা যেমন থাকবে, তেমন ছোটরাও থাকবে। তবেই তো ভালো করা সম্ভব হবে। আমরা যদি চায়নার দিকে তাকাই, ওরা ছোট-বড় মিলে রয়েছে। তারা বড় অর্ডারগুলো যেমন দিতে পারে তেমন ছোট ছোট অর্ডারগুলো খুব সহজেই দিতে পরে। আমরা কমপ্লায়েন্স হব। সেটা ভালো কথা। তাই বলে এই না যে, ছোটরা উঠে আসতে পারবে না। একটা সময় ছিল যখন আমরা মাত্র দুই সিজন নিয়ে কাজ করতাম। এখন অনেকগুলো সিজন তৈরি হয়ে গেছে। বায়াররা একেকটা সিজনে একেক ধরনের অর্ডার দিচ্ছে। অনেক সময় আমরা বায়ারদের ছোট ছোট অর্ডারগুলো নিতে পারছি না। যদি কোয়ালিটি সম্পন্নœ ছোট ছোট ফ্যাক্টরি থাকে তাহলে আমরা বায়ারদের যেসব ছোট অর্ডারগুলো রয়েছে সেটা নিতে পারি। বড় কারখানার ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছোট ছোট অর্ডারগুলো নেওয়া যায় না। ছোট কারখানাগুলো এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে পণ্যের কোয়ালিটির ভালো করতে হবে। কারণ বড় কারখানাতে কম লটের পণ্য তৈরিতে খরচ বেশি পড়ে যায়। অন্যদিকে আমরা শুধু বড় বড় লাইন করে বা বড় বড় কারখানা করি। স্পেশালাইজড ছোট ছোট কারখানা কমে যাচ্ছে। বায়ারদের মাঝে বাংলাদেশকে নিয়ে একটা পরিচিতি হয়েছে যে, আমরা বড় বড় অর্ডার নিয়ে থাকি। ছোট অর্ডার করতে অভ্যস্ত না। এতে করে আমাদের একটা ক্ষতি হচ্ছে। করোনার কারণে এখন অনলাইন সেলটা বেশি বেড়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে অনলাইন হবে সব থেকে বেশি শক্তিশালী সেল মাধ্যম। অনলাইনে বড় সেলের চেয়ে ছোট বা মাঝারি সেলগুলো বেশি হচ্ছে। যেমন ধরা যাক প্যান্ট বা শার্ট টাইপের পণ্য বাল্ক আকারে বিক্রির সুযোগ নেই। ছোট ছোট ভলিয়ম আকারে বায়াররা ক্রয় করে থাকে। তবে ওরা কোয়ালিটির উপর জোর দিচ্ছে। আমরা বড় কারখানার কারণে এই ছোট ছোট অর্ডারগুলো নিতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য সমস্যা।
পোশাকে বর্তমানে নানা বৈচিত্র এসেছে জানিয়ে মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আগে ধরাবাঁধা দুইটা বা তিনটা সিজন পণ্য ছিল। এখন দেশের পোশাকখাত আর সেই জায়গায় নেই। অনেকগুলো সিজন বায়াররা তাদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সিজনের ফাঁকে উৎসবমুখর অনেক অকেশনকে সামনে রেখে বায়াররা অর্ডার দিয়ে থাকে। আর এ টাইপের অর্ডারগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে থাকে। কোয়ালিটি পণ্য কোয়ান্টিটি ছোট, এ টাইপের অর্ডারগুলোর ডিমান্ড বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এ জায়গায় পিছিয়ে যাচ্ছি। তবে ছোট অর্ডার যে আমরা একেবারে দিতে পারি না তা কিন্তু নয়। আমরা দিচ্ছি, তবে চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারখানা গড়ে না ওঠার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বড় কারখানা করতে যে মানের কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় ছোট কারখানাতেও তাই। বড় লাইনে কারখানাগুলোতে ছোট অর্ডারের পণ্য তৈরির খরচ বেড়ে যায়।
পোশাক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছোট কারখানা বড় কারখানার কাগজপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় একই খরচ। ছোট কারখানা তৈরি না হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। আবার বড় কারখানা তৈরিতে যে খরচ হয় তা উঠে আসতে যে পরিমাণ সময় লাগে অনেক সময় ছোট কারখানার ক্ষেত্রে তুলনামূলক তারচেয়ে বেশি সময় লাগে। ছোট কারখানাগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে মাঝপথে তার যদি কোনো অর্থায়নের প্রয়োজন হয় অনেক সময় সেটা যোগান দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। একজন নতুন ছোট উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে তা আরও কঠিন। এসব মিলে বলা যায়, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের দেশে ইনফ্রাস্ট্রাকচার গত কিছু সমস্যা রয়েছে। আমরা যদি নতুন ছোট উদ্যোক্তা তৈরি করতে চাই, বেসরকারি এবং সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু কাজ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি অ্যাপারেলে আমরা অনেক এগিয়ে আছি। এরপরেও এখনো আমাদের বাইরে থেকে এক্সপার্ট নিয়ে এসে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশে শিক্ষাগত এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার গত তেমন ডেভলপমেন্ট হয়নি।
নতুন উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের আগে পোশাকখাতের বিভিন্ন বিষয়ে ভালোভাবে জানতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখাতে কেউ যদি বিনিয়োগ করতে চায় তবে তাকে বেশকিছু বিষয় জানা প্রয়োজন। অন্যথায় টিকে থাকা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে আমরা বেসিক কিছু কাজ করতাম। ফলে ওই সময়ে বিনিয়োগ করা বর্তমান সময়ের তুলনায় সহজ ছিল। তেমন কোনো স্টাডি বা পলিসি প্রয়োজন হত না। এখন আর সেই অবস্থান নেই। আমরা যদি বাংলাদেশের পোশাক তৈরির ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এখানে সস্তা শ্রমের কারণেই পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। এখন আর শুধু সস্তা শ্রম দিয়েই আপনি টিকে থাকতে পারবেন না। আপনাকে কোয়ালিটি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে কমপ্লাইন প্রোডাক্ট দিতে হবে। আর একজন নতুন উদ্যোক্তাকে এসব করতে হলে স্টাডি বা গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আপনাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে প্যাটার্ন ও পণ্যের মান। বুঝতে হবে বায়ারের চাহিদা।
তরুণ পোশাক ব্যবসায়ীদের নতুন সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইয়ুথ লিডার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বায়লার বিষয়ে রুবেল বলেন, সংগঠনটি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের সুনাম তুলে ধরা, বাজার গবেষণা, পণ্য বৈচিত্র্য করতে নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিতে যারা আছে আল্টিমেটলি গার্মেন্টস সংক্রান্ত যতগুলো লিংকেজ খাত রয়েছে এখানে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যাতে করে খুব সহজেই তাদের ব্যবসা সপ্রসারিত করতে পারে। ওদের আইডিয়া শেয়ার করার জন্য এ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। তাদের আইডিয়াগুলোকে আরও উঁচু পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে ওরা বিজিএমইএর কাছে শেয়ার করতে পারবে। ওরা যত বেশি ভালো করবে এ খাতের জন্য ততো বেশি ভালো হবে। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও
