আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খসড়া নীতিমালা কুরিয়ার সার্ভিসে ক্যাশ অন ডেলিভারিতে ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক
মো. আখতারুজ্জামান : ক্যাশ অন ডেলিভারি দেয়া কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর পণ্য ডেলিভারি দেয়ার মাধ্যমে যে নগদ মূল্য সংগ্রহ করে সে অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন বাধ্যতামূলক করতে বাংলাদেশ ব্যাংক খসড়া নীতিমালা করেছে। অন্যদিকে ফেসবুক বা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন তাদেরও বাধ্যতামূলক ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর লেনদেন বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় যে যারা মত করে চালাচ্ছে। এতে করে কি পরিমাণ ব্যবসা করছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান থাকছে না। নীতিমালা হলে একদিকে যেমন গ্রাহক হয়রানি কমে আসবে অন্যদিকে সরকার সঠিকভাবে ট্যাক্স সংগ্রহ করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, এদের বিষয়ে আমাদের কোনো নীতিমালা নেই। তাদের ব্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা করতে চাচ্ছি। এই নীতিমালায় অনেক কিছুই রাখা হবে। কিভাবে তারা সেবা দিবে, কারা এই ব্যবসা করতে পারবেÑ এমন অনেকে কিছুই রাখা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। খুব শিগগিরই এই নীতিমালা আসছে। এতে করে ট্যাক্স আহরণ সহজ বলে তিনি জানান।
যেসব কুরিয়ার সার্ভিস ক্যাশ অন ডেলিভেরি দিতে চায় তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এছাড়া, কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি) এর সদস্য হতে হবে। এসব বিধান করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা খসড়া তৈরি করে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের জন্য পাঠিয়েছে। জানা যায়, সারাদেশে ডেলিভারির সঙ্গে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রায় ৫০ হাজার কর্মী সম্পৃক্ত রয়েছেন। দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে অনলাইনে কেনাকাটায় আগে দাম পরিশোধের হার তুলনামূলক কম। ক্রেতাদের পছন্দ হচ্ছে পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা দেয়া। ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধের কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তার সংখ্যা কম।
বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ছিল ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার অনলাইনে পেমেন্ট হয়েছে। এ জন্য কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে ব্যাংকে সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। ওই অ্যাকাউন্টে ক্যাশ অন ডেলিভারির টাকা ছাড়া অন্য কোন অর্থ লেনদেন করা যাবে না।
ক্যাশ অন ডেলিভারি ও কন্ডিশন বুকিংয়ের মাধ্যমে পণ্য বিতরণ থেকে যে অর্থ সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা হবে, তার বিপরীতে পণ্যের ঘোষিত মূল্যের সব ভাউচার কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের সেন্ট্রাল ডাটা সিস্টেমে দৈনিক ভিত্তিতে সংরক্ষণ করতে হবে, যা সেটেলমেন্ট হিসাবধারী ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে যাচাই করতে পারবে। এতে অসঙ্গতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট স্থগিত বা বন্ধ করে দিতে পারবে।
খসড়া গাইডলাইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ডাক বিভাগ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ অন ডেলিভারি প্রক্রিয়া পরিদর্শন করতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ডেলিভারি সিøপের বিপরীতে ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করে নগদ অর্থ গ্রহণের পর বিতরণ করা সকল পণ্যের বিপরীতে পাওয়া অর্থ ব্যাংকের নিজস্ব সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা দেবে। ডেলিভারি ম্যান বা কুরিয়ার সার্ভিসের লোকাল অফিস বা এজেন্ট এবং এ সংক্রান্ত সব তথ্য তাদের সিস্টেমে ইনভয়েসের বিপরীতে সংরক্ষণ করবে। স্থানীয় ব্যাংক জমা করা অর্থ সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, স্থানীয় ব্যাংক শাখা জমা হওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা করবে। সেখান থেকে নিজের কমিশন রেখে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান পণ্যের বিক্রেতার অংশ ব্যাংক, এমএফএস বা পিএসপি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে স্থানান্তর করবে।
যেসব ই-কমার্স বিক্রেতার ব্যাংক একাউন্ট নেই, তাদের ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিসের সেটেলমেন্ট একাউন্টে জমা হওয়া অর্থ হতে ইনভয়েসের বিপরীতে বিক্রেতার প্রাপ্য মূল্য নগদে পরিশোধ করবে, যা কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে। তবে নগদ উত্তোলনের পরিমাণ কোনোভাবেই যেকোন সময়ের মোট স্থিতির ১০ শতাংশের এর বেশি হতে পারবে না।
তিনি জানান, বর্তমানে সারাদেশে ৫০০ এরও বেশি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান থাকলেও সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে ৫০টির ডাক বিভাগের লাইসেন্স রয়েছে। সব মিলিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর ডেলিভারি ম্যানের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো।
তবে এলাকা ও ব্যবসার ধরনভেদে ট্রেড লাইসেন্স ফি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এর বাইরে ভ্যাট, সাইনবোর্ড ট্যাক্স, ফিজিক্যাল ভিজিট ট্যাক্সসহ প্রায় চার হাজার টাকার মতো খরচ হবে। এতে সরকারের আয় হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া, প্রতিবছর ট্রেড লাইসেন্স আবার নবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণিভেদে কুরিয়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া, জামানত হিসেবে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয় তিন লাখ থেকে ২.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত। এখান থেকেও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে সরকার।
অন্যদিকে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের মধ্যে একই শহরে এবং ১০ দিনের মধ্যে ভিন্ন শহরে পণ্য সরবরাহ করবে। নির্ধারিত সময়ে এবং সঠিক পণ্য সরবরাহ না করলে ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা অন্য যে কোন আদালতে মামলা করতে পারবেন। ই-কমার্সে প্রতারণা বন্ধ করা এবং ক্রেতাদের আস্থা তৈরি করে এ খাতের বিকাশের জন্য ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ শিরোনামে তৈরি করা খসড়ার ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে।
আগামী ২১ মার্চ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে একটি বৈঠকের পর বাড়তি কোন মতামত পাওয়া গেলে তা সংযোজন-বিয়োজন করে আগামী মাসেই এটি জারি করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনসহ দেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট সব আইন এ নির্দেশিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়ে এবং সঠিক পণ্য ডেলিভারি না করলে ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা অন্য যে কোন আদালতে মামলা করতে পারবে।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, আমাদের দেশে ই-কমার্স ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এমন কিছু করা যাবে না যাতে এই উদীয়মান খাতের জন্য ক্ষতি হয়। আমাদের এখানে বড় বড় বিনিয়োগকারি যেমন আসছে তেমন ছোট ছোট বিনিয়োগকারিও আসছে। নীতিমালার বেড়াজালে ছোটরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে নীতিমালা করতে হবে। খসড়া নীতিমালায় কিছু সমস্যা শনাক্ত করে আমরা বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছি। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও