করোনা মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে বিকল্প ভাবতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাড়ছে সংক্রমণ, সতর্ক করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রিয়াংকা আচার্য্য ও সুজন কৈরী : রাজধানীতে হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধিতে রোগী ভর্তির চাপ বেড়েছে তালিকাভুক্ত হাসপাতালে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বেড খালি নেই। শুধু তাই নয়, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেডও রোগীতে পূর্ণ। বুধবার এমন তথ্যই দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর থেকে আরও জানা যায়, রাজধানীর তালিকাভুক্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের মোট ২৬৭টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ২২২ জন। বর্তমানে বেড ফাঁকা রয়েছে ৪৫টি। আর দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ৫৪৯টি। তার মধ্যে বর্তমানে রোগী ভর্তি আছেন ৩২৩ জন, বেড ফাঁকা রয়েছে ২২৬টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩ হাজার ৫৬৭ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; মৃত্যু হয়েছে আরও ২৫ জনের। দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরের জুলাই মাসের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়।
এ প্রেক্ষাপটে সাধারণ ছুটি বা লক ডাউন আসতে যাচ্ছে কি না বা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে কি না এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। নানা গুঞ্জন-গুজবে ভারী হয়ে উঠেছে আমজনতার আড্ডা। তবে ‘লকডাউনের’ কোনও সিদ্ধান্ত এ পর্যন্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বুধবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত যখন হয়, তখন আমরা জানিয়ে দেব। লকডাউনের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেয় না। যেসব জায়গার কারণে রোগী বাড়ছে, সংক্রমণ বাড়ছে, ঐ জায়গাগুলো যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে আমি মনে করি সংক্রমণের হার কমে যাবে, রোগী বাড়বে না। কাজেই উৎপত্তিস্থলগুলোকে (পর্যটনের স্থানগুলো) আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তারপর আমরা অন্যকিছু চিন্তা করব। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোও কোভিড ইউনিট বাড়াতে বলা হয়েছে।’
অপরদিকে করোনা সংক্রমণ বিবেচনায় রাত ৮টার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডিএসসিসি মেয়র আরও বলেন, ‘আমরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমরা চাই, ৮টার মধ্যে সব বন্ধ হলে সংক্রমণও কমে আসবে এবং আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবো।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ছুটি বা লক ডাউন দিলেই যে করোনা পরিস্থিতি উত্তরণ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। এ নিয়ে সরকারকে বিকল্প কিছু ভাবতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এখনই করোনার দ্রুত ছড়িয়ে পরা রোধ করার সময়। সরকার ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে। সাধারণ ছুটি বা লকডাউন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সঠিক পথ নয়, এজন্য সরকারকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন জানান, দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখে এখনই সাধারণ ছুটি ঘোষণা প্রয়োজন। এক্ষত্রে অর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সরকার বিকল্প চিন্তা করতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বিভাগের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা প্রতিদিনিই নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। গত বছরের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। করোনা থেকে রক্ষায় আমাদের স্বাস্থ্য বিধি মানতে বাধ্য করা উচিত। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। এখনই সাবধান না হলে ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা।
এদিকে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আবারও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। আগামী দু’এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এর আগে করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আগামী ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি নির্দেশনার আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে খোলার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়।
এদিকে করোনার সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় কঠোর হচ্ছে প্রশাসন। ‘মাস্ক পরার অভ্যাস, কোভিডমুক্ত বাংলাদেশ’ শ্লোগানে দেশজুড়ে বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়েছে পুলিশ। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় জনগণকে সচেতন করার প্রয়াসে পরিচালিত অভিযানে সড়ক ও গণপরিবহনে যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদের মাস্ক পরার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়।