পঞ্চাশ বছরের সংক্ষিপ্ত সালতামামি
মিরাজুল ইসলাম
বাংলাদেশ নামের ভূখ-টি পঞ্চাশ বছরে পা রাখলো। রাষ্ট্র যদিও কোনো রক্ত মাংসের ব্যক্তি বা মানুষ নয়। কিন্তু তার নিজস্ব বয়সের হিসাব রাখা হয় মহাকালের সূত্র মেনে। স্বাধীনতার পর থেকে তার অভ্যুদয় পরবর্তী দিনক্ষণ গণনা করা হচ্ছে ঠিক যেন একটা শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার উত্তেজনায়। একটি শিশু যেমন তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নানামুখী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, তেমনি একটি দেশ তার যাবতীয় প্রভাবকের মাধ্যমে নিজের অবস্থান বৈশ্বিক মানদ-ে দৃঢ় করবার ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
ব্যক্তি মানুষের মতো রাষ্ট্রেরও নিজস্ব রোগ-শোক থাকে। সমাজের রন্ধ্রেও দানা বাঁধে স্বার্থ বিনাশী জীবাণু। মূলত তিনটি উপাদান রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলেছে। তা হলো ক্ষমতার রাজনীতি, ধর্মীয় আবেগ এবং বাজার অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ এই তিন জীবাণুর আক্রমণে প্রতি দশকে পর্যুদস্ত হয়েছে। বদলে গেছে তার জাতি সত্ত্বার সূত্রগুলো। রং বদলেছে গণতান্ত্রিক অবকাঠামোয়। সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে দেশের আগামী প্রজন্মের মাঝে।
ক্ষমতার রাজনীতিতে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম এক দশক ছিল আদর্শিক চেতনার সাথে প্রতিহিংসাপরায়ণ ভাবধারার মিশেলে পালাবদলের রক্তক্ষয়ী খেলা। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা তখন থেকে তৎপর ছিল। রাজনৈতিক বিভেদের উল্লেখযোগ্য পালাকার হিসেবে তারা ক্রমে প্রধান রাজনৈতিক ঐচ্ছিক শক্তি হিসেবে আত্মস্থ হতে থাকে। ‘৮০ দশকের পর থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে থাকলো দুর্নীতি ও ভোগ বিলাসের মন্ত্র। ক্রমে উপমহাদেশীয় রাজনীতির ঐতিহ্য অনুযায়ী গণতন্ত্রের পোশাকে প্রতিষ্ঠিত হলো পরিবারতন্ত্র।
ধর্মীয় আবেগ এদেশে কখনো যুক্তি মানেনি। ধর্মভীরু একটি জাতি ক্রমে রাজনীতির খোলসে বদলে গেল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাফল্য পরিবর্তিত হলো ক্ষমতা উপভোগের মাধ্যম হিসেবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ইসলামফোবিয়াকে উপজীব্য করে ধর্মীয় গোঁড়ামি আমদানি হলো সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো ধর্মীয় মোল্লাদের মন জয় করতে। যার পরিণতি পুরো দেশবাসীর মননকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ধর্মীয় ভাবমূর্তির লেবাসে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লাল সালু’র উক্তিটি যেন এখন সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্যÑ ‘ধর্মের চেয়ে টুপি বেশি, শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি।’ বাজার অর্থনীতি জনগণের যাবতীয় কর্মস্পৃহাকে নিয়ন্ত্রণ করলেও রাজনীতি এবং ধর্ম এই স্বাধীন জাতিকে ব্যস্ত রেখেছে গত তিন দশক। তার প্রমাণ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের ঊর্ধ্বগতির ব্যাপারে তাদের কাগুজে নিস্পৃহতা। বিশেষ করে টাকার মান ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত এ নি¤œ আয়ের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করলেও মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যান্য নিয়ামকের জোরে তা চাপা পড়ে থাকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে গত দুই দশকে কর্পোরেট জগতের প্রসার। একইসাথে ডিজিটাল প্রযুক্তি সেবার স্বাচ্ছন্দ্য ও মোবাইল ফোনের বিনোদন পরিবর্তন এনেছে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশে। পঞ্চাশ বছর পর এটা এখন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। লেখক ও চিকিৎসক