স্বাস্থ্যখাত : শত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বিপুল অর্জন
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
গত কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিরাজমান। বরাবরই জনগণের মাঝেও ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কমতি নেই। ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনাকালীন সময়ে একদিকে যেমন চলেছে ধ্বংসের তা-বলীলা, অন্যদিকে উন্মোচিত হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক নগ্ন দিক। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভি খুললেই দেখা যেতো, ‘চিকিৎসা সেবা পাতালে’, ‘সেবার নামে বেহাল অবস্থা’, ‘অভিজাত হাসপাতালগুলো বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত’, ‘সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা’, ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা মেলে না’, ‘খোদ রাজধানীতেই অস্ত্রোপাচার করলেন ভুয়া ডাক্তার, অপারেশন টেবিলেই রোগী রেখে পালালেন তিনি, ভুল চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ নষ্ট’ এসব চাঞ্চল্যকর অপ্রিয় সত্য কথা। করোনাভাইরাস আসার পর এই খবরগুলো বদলে গেছে। এখন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দেখা যায়, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট, হাসপাতালে হাই-ফ্লো অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, প্রয়োজনীয় আইসিইউর অভাব, বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে রাস্তাতেই করোনা রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্য বিধি না মেনে রাস্তাঘাটে জনগণের ঢল, পর্যটন এরিয়া গুলোতে ছুটিতে জনগণের জোয়ার, স্বাস্থ্যখাতে ও ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্নীতি- এই ধরনের বিভিন্ন সংবাদে।
একটি অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে, রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগের পাহাড়, যেমন হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা হয় না, ডাক্তার নার্স ঠিকমত রোগীকে মনোযোগ দিয়ে দেখে না, চিকিৎসকের উচ্চ ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন ও ওষুধ কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নানা উপঢৌকনের বিনিময়ে ওষুধ লেখা এবং অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার, এমনকি অনেকের দৃষ্টিতে ডাক্তাররা ‘কসাই’। অভিযোগগুলো অযৌক্তিক নয়, অনেকাংশেই সত্যও বটে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও হাতে গোনা, সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীরা সহজে তাদের দেখা পান না, বাধ্য হয়ে সুচিকিৎসার আশায় যেতে হয় প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানেও রোগীদের লম্বা লাইন। আবার বিশেষজ্ঞদের সিরিয়াল পেতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাদের অনেক রোগী দেখতে হয়, তাই প্রত্যেক রোগীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। অনেকের অভিযোগ, বেশি টাকা ফি নিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর গায়ে হাত না দিয়েই বা কথা ভালোভাবে না শুনেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। এমনকি একগাদা ওষুধসহ অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, তাও আবার নিজের পছন্দসই ল্যাবরেটরীতে। তড়িঘড়ি করে দেখার ফলে চিকিৎসকের প্রতি রোগীরা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন ও আস্থা রাখতে পারছেন না। সামর্থ্যবান রোগীরা চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। এছাড়া চিকিৎসার খরচও দিন দিন বেড়েই চলছে। হঠাৎ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার খরচ মিটাতে হিমসিম খেতে হয়। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ সুবিধা কম থাকায়, প্রত্যাশিত সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয় না।
বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ আকাশচুম্বী, সেখানে চিকিৎসা নেওয়া অনেকেরই সামর্থ্যরে বাইরে। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার-নিরীক্ষার মানহীনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্টের ব্যবহার, প্রায়ই অনেক ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্টের অভিযোগ, অদক্ষ টেকনিশিয়ান আর ভুয়া ডাক্তারের আধিক্য, এমনকি দালালদের দৌরাত্মে রোগীরা দিশেহারা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অভিযান চালান, সাথে সাথে অনিয়মের দায়ে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু তাতে অবস্থার পরিবর্তন হয় না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ও প্রশাসনিক অদক্ষতায় ভরপুর, গ্রামে-গঞ্জে, উপজেলা, জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে সারাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্রটাই ফুটে ওঠে সর্বত্র। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে একটি বিষয়ে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধু ডাক্তার বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে জনগণকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা প্রদান করা কখনোই সম্ভব হয় না। বরাবরই ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাঁধে বন্দুক রেখে পর্দার পেছনের মানুষরা পার পেয়ে যায়। এবারে করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যের বরাদ্দ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যথাযথ এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্তা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং উদাসীনতা ইত্যাদি অনিয়মগুলোকে উন্মোচিত করে দিয়েছে এবং এগুলোই জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লেখক : ইউ. জি. সি. অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক