লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দাঁড়ানো উচিত : ড. আতিউর রহমান
আমিরুল ইসলাম : বাংলাদেশে ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, গত বছর লকডাউনের সময় অনেক এনজিও এবং সামাজিক সংগঠন বিপন্ন মানুষের খাবার ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। এমনকি বিপন্ন শিল্পীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি বিশেষ এ ধরনের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। জানি না কী কারণে এবারে সমাজ ততোটা সক্রিয় হচ্ছে না। আমাদের ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রণোদনা যথেষ্টই নিয়েছেন। তারাই-বা কেন এই দুর্যোগে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসছেন না? ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চয়ই তাদের সামাজিক দায়বোধ কর্মসূচির অধীনে সামাজিক ও অসরাকারি প্রতিষ্ঠানকে এই দুঃসময়ে সহযোগিতা করবে সে প্রত্যাশা নিশ্চয় করতে পারি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাস্টেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ এই সামাজিক দায়বোধের কাজে নেতৃত্ব দেবে তেমনটিই আশা করছি। আশা করি, এবারের সংকটেও সমাজ তার কাক্সিক্ষত দায়িত্ব পালনে পিছপা হবে না। আর সরকার তো তা করবেই। সেটিই যে তার কাজ।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, গতবছর আমরা যে ধরনের সারা দেখেছিলাম সমাজের পক্ষ থেকে এবছর সেরকমটি দেখতে পাইনি। এর একটি বড় কারণ আমাদের জাতীয় মনস্তত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে। একবার সংকট এলে মনে হয় যে আর আসবে না। একবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলে মনে হয় যে আর আসবে না। সেজন্য আমরা সমস্ত কিছুর হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু আবার যখন আসে তখন আবার চিন্তা করি। বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে চলা আমাদের সমাজে এখনো গড়ে ওঠেনি। করোনা মহামারির কারণে যে লকডাউন চলছে, তার ফলে যারা যারা বিপদে আছে তাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের কাছে খাদ্য এবং অর্থ সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়া যেমন সরকারের কাজ, একইসঙ্গে সমাজেরও দায়িত্ব।
এবারের সংকট গতবারের চেয়ে আরও গভীর হবে। কারণ গত বছর মানুষের কাছে কিছু সঞ্চয় ছিলো, সে সঞ্চয় ভেঙে ভেঙে তারা খেয়েছে। এবার কিন্তু হাত সঞ্চয়ও নেই মানুষের। সেজন্য সরকার চেষ্টা করছেন। ৩৬ লাখ মানুষ যারা অর্থমন্ত্রণালয়ের এবং স্থানীয় প্রশাসনের ডেটাবেজে চলে এসেছে। সেই ডেটাবেজে কিছুটা সমস্যা থাকলেও দ্রুত টাকাগুলো মানুষের কাজে পৌঁছে দিতে হবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। বিশেষ করে ওয়ার্ড প্রতিনিধি, মেয়রের অফিস, সরকারের প্রশাসন, এনজিও ও সামাজিক কমিউনিটি মিলে যেখানেই সমস্যা হয় সেখানেই সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য দরকার হলে সরকারের হটলাইন ব্যবহার করতে হবে। কেউ না খেয়ে থাকলে হটলাইনে টেলিফোন করলে সেই মোতাবেক সারা দেওয়া। আগের বার স্থানীয় প্রভাবশালী, বিত্তবান মানুষেরা ও ওয়ার্ড কমিশনারেরা নানাভাবে মানুষের বিপদে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন সেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, কৃষিপণ্য বিশেষ করে শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য যেখানে বিক্রি হচ্ছে না সেখানে স্থানীয় প্রশাসন সেগুলো ক্রয় করে পুলিশ লাইনে ব্যবহার করতে পারে, হাসপাতালে ব্যবহার করতে পারে, জেলখানাতে দিতে পারে। এইভাবে বাজারও ঠিক রাখতে হবে আবার একইসঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কাজ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আমাদের দেশের বড় বড় যে মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে এগুলোর কার্যক্রম সরকার চালু রেখেছে। এটা খুব ভালো কাজ করেছে। আমাদের গার্মেন্টসগুলো চালু রেখেছে, এটাও খুব ভালো কাজ করেছে সরকার। এ ধরনের কাজ আরও করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গতবছর ৩১টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার একটি নির্দেশনা ছিলো- শহর পরিষ্কার রাখা এবং আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা। শহরের ড্রেনগুলো যদি পরিস্কার করা হয় , সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। এর জন্য তো লোক লাগবে। যারা কোদাল নিয়ে রাস্তায় বসে আছে শ্রম বিক্রির জন্য তাদের কাজে লাগাতে হবে। একবার যারা কাজে আসবে তাদের ডেটাবেজ তৈরি করে যখনই প্রয়োজন হবে তাদের কাজে লাগানো এবং তাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেওয়া। ঋণ নিতে মানুষ এখন খুব বেশি আগ্রহী হবে না। কারণ ঋণ নিয়ে যে পণ্য তৈরি করবে সেগুলো খাবে কারা যদি মানুষের কাছে টাকা না থাকে। সেজন্য মানুষের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়াটা বড় দরকার। জো-বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো পরিকল্পনা করেছে। আমাদেরও এখন সেরকম পরিকল্পনা করা উচিত। গ্রামে, গঞ্জে ও শহরে যেখানে ছোট ছোট পূর্ত কর্মের দরকার, স্কুল-কলেজের মেরামত দরকার, রাস্তা ভেঙে গেছে ঠিক করা দরকার, ব্রিজ মেরামত করার মতো কাজগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেখানে যারা কাজ করতে পারে তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া। যারা কাজ করতে পারবেন না তদের কাছে সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে ও এর আয়তন বাড়িয়ে দিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে সরকার এতো টাকা কোথা থেকে পাবে? আমি আগেও বলেছি এবারও বলছি সংকটকালে প্রয়োজন হলে আমরা আরও বেশি সরকারি ঋণ করবো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমরা এই অর্থ মানুষের জন্য খরচ করবো। এই খরচের একটা বড় অংশ হওয়া উচিত আমাদের স্বাস্থ্যখাতে। স্বাস্থ্যখাতে এ বছর গতানুগতিক বাজেট দিলে চলবে না। এবারের বাজেট হতে হবে আরও বেশি বড় ও সুদূরপ্রসারী। কয়েকবছর ধরে স্বাস্থ্যখাতকে সংস্কার করার জন্য বাজেট দিয়ে যেতে হবে। মহামারী থেকে বের হয়ে আসবার একটা বড় ভরসার কেন্দ্র হলো আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। সুতরাং কোনো অবস্থাতে আমাদের ডাক্তার, নার্সকে কেউ যেন অসম্মান না করে। বরং তাদের সম্মান করে, তাদেরকে বাড়তি যে সুবিধা দেওয়ার কথা, তাদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার ওপরে নজর রাখতে হবে। ডাক্তারদের খুবই সম্মানের চোখে দেখা হবে, এসময়ের সবচেয়ে বড় কাজ।