বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চালু করতে প্রয়োজন সরকারি পদক্ষেপ লিনিয়ার থেকে সার্কুলার অর্থনীতিতে বিশ্ব
মেহেদী হাসান : বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতি সম্পর্কিত আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সার্কুলার বা বৃত্তাকার অর্থনীতি। বিভিন্ন দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এই অর্থনীতি। যদিও বাংলাদেশে এখনও বিষয়টি ততোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
যদিও পরিবেশবিদগণ মনে করেন বিষয়টিকে এখনই যথাযথ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাাতিক উন্নয়ন বিভাগ একটি জড়িপের মাধ্যমে উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে সার্কুলার অর্থনীতির অবস্থান দ্বিতীয়। আন্তজার্তিক প্রতিযোগিতায় অগ্রগতি, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০১৪ সালেই সার্কুলার অর্থনীতিকে বেছে নিয়েছে (আন্না আভডিয়াসকেহেনকো, ২০১৮)।
১৯৯৬ সালে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ কেনেথ ই. বোল্ডিং উৎপাদনের এই চক্রাকার পদ্ধতি নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘দি ইকোনমিক্স অব ন্যাচারাল রিসোর্স অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট’ বইয়ে নিস এ. অর্থনীতির পরিভাষা হিসেবে ‘সার্কুলার অর্থনীতি’ বা ‘বৃত্তাকার অর্থনীতি’ অভিধাটি ব্যবহার করেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানিশক্তির উৎস রূপান্তরের মাধ্যমে সার্কুলার-মডেলটি অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক মূলধন তৈরি করে।
বর্তমানে বিশ্বঅর্থনীতির মূলধারা প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক লিনিয়ার পদ্ধতি। এতে প্রযুক্তি নতুন পণ্য তৈরি করে মানুষ তা ব্যবহার করে বর্জ্য ফেলে দেয়। অন্যদিকে, সার্কুলার পদ্ধতি ভূ-পৃষ্টের উপরিভাগের সম্পদ (কম মাত্রায় ভোগ, পুনঃব্যবহার ও রিসাইকেল) নির্ভর অর্থনীতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত তথা সুখী সুন্দর, সবুজ-টেকসই সমাজ গঠনে এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে ‘সার্কুলার অর্থনীতি’। কেননা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ব্যবহৃত যে বস্তু আছে তা ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করে, বর্তমান সমাজের চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে এক অভাবনীয় সুযোগ প্রদান করতে চলছে সার্কুলার অর্থনীতি।
বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিবন্ধকতাসমূহ যেমন- জলবায়ু পরিবর্তন, কাঁচামালের স্বল্পতা, দূষণ, জ্বালানী সংকট, পরিবেশগত সংকট, কর্মসংস্থান, সুপেয় পানির অভাব, সামাজিক উন্নয়নে অসাম্য ইত্যাদির সমাধান হতে পারে সার্কুলার অর্থনীতি।
বিগত সময়ে ওয়ান টাইম ইকোনমি তৈরি করেছে ভোগ করে ছুড়ে ফেলার সংস্কৃতি, যা প্রভাব ফেলেছে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। প্রয়োজনে কারও সাথে সম্পর্ক চর্চা, প্রয়োজন শেষ হলে তাকে ছুড়ে ফেলা। তার বিপরীতে এই অর্থনীতি প্রতিটি জিনিষ পুণরায় ব্যবহার করার মাধ্যমে সংস্কৃতির এই ধারাকেও প্রতিরোধ করবে। ইউরোপের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান মিলে জোটবদ্ধ হয়ে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে নতুন ব্যবস্থা। এতে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য যেমন টিভি, ফ্রিজ, এসি কোন কিছুই মানুষকে কিনতে হবে না। তারা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভাড়া নেবে, ব্যবহার করবে, ব্যবহার শেষে বা নষ্ট হলে ফেরৎ দিয়ে দেবে। উক্ত প্রতিষ্ঠান পণ্যটিকে সার্ভিসিং করে আবার ভাড়া দেবে নতুন কাউকে। যে কোন পণ্যের ডিজাইন থেকে শুরু করে পণ্য ব্যবহারের পরে তা পুনরায় কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করার পথকে নিশ্চিত করবে।
পরনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে স্বনির্ভর অর্থনীতির পথকে সুগম করতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে সার্কুলার অর্থনীতি। প্রাসঙ্গিকতায় বলতে হয়, কোভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কোন ধরনের অর্থনীতি নির্ভর বিশ্বকে রেখে দিতে চাই আগামী প্রজন্মের জন্য।
সার্কুলার অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিতরা মনে করেন, সার্কুলার অর্থনীতি এক আদর্শ অর্থনীতি ভিত্তিক ব্যবসায় মডেল, যা নতুন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটাতে চলেছে।
সে কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, চীন, এবং রাশিয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো/ ডলার অনুমোদন করেছে এই সমন্বিত অর্থনীতির ব্যবসার মডেলকে ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই সমাজ ব্যবস্থার বাধাগুলোকে দূর করার জন্য। যেমন- জাতিসংঘ ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স (কোপ-২১), প্যারিস, নভেম্বর ২০১৫, বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশ অংশগ্রহণ করার মধ্যদিয়ে একমত হতে চেয়েছে এই বলে যে, টেকসই সমাজ গঠনে বিশ্বে উদ্ভাবিত নতুন সমন্বিত অর্থনীতির মডেল কাজে লাগাতে হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের সুন্দর জীবনের জন্য।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত ফিনল্যান্ড সার্কুলার অর্থনীতির উন্নয়ন এবং তা ব্যবহারে বিশ্বের একটি পাইওনিয়ার দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম সার্কুলার অর্থনীতি ব্যবসা মডেলের রোডম্যাপ ২০১৬-২০২৫ তৈরি করে। কোভিড-১৯কে সামনে রেখে ইউরোপিয়ান কমিশন প্রকাশ করেছে নতুন সার্কুলার ইকোনমিক মডেল।
উন্নত বিশ্বে প্রাধান্য পেয়েছে ডিজিটালাইজেসনের সঙ্গে পণ্য-অংশীদারমূলক সেবা পদ্ধতি। সার্কুলার অর্থনীতির নীতিমালাকে সামনে রেখে ইউরোপ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বর্জ্যকে যাদুঘরে পাঠাতে। জাপানের এনইচকে টেলিভিশনের একটি তথ্যচিত্রে দেখা গেছে তারা গৃহস্থালী বর্জ্যকে ২৯ টি ভাগে বিভক্ত করে, পূনরায় ব্যবহারের জন্য।
চট্টগ্রামে ২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল দুই একর জায়গায় ‘গার্বেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ প্রকল্প স্থাপন করে আবর্জনা থেকে জৈব সার উৎপাদন শুরু হয়। এই সার ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি খাতে। প্রতিদিন চার টন করে মাসে ১২০ টন আবর্জনা প্রক্রিয়া করে ৭০ থেকে ৮০ টন সার উৎপাদন করা যায়। উৎপাদিত প্রতি কেজি পাউডার সারের মূল্য ৯ টাকা এবং দানাদার সারের মূল্য ১২ টাকা। ডিলারের মাধ্যমে সারা দেশে এবং পাইকারি ক্রেতার মাধ্যমে চট্টগ্রামে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু এই সারের বাজার এখনো সেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েনি। এই প্রযুক্তিত খুব বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। চট্টগ্রামের এই প্রকল্পে বর্তমানে সার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে দুটি কাটিং মেশিন, একটি নেটিং মেশিন, চারটি মিলিং মেশিন ও চারটি দানাদার মেশিন। সব মিলিয়ে মোট খরচ পনেরো থেকে বিশ লাখ টাকার মধ্যে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তদের জন্য এটা হতে পারে খুবই লাভজনক একটি প্রকল্প। এমন প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তারা কেবল নিজের ব্যবসার বিকাশই নয়, পরিবেশ ও কৃষিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।
আসিসিসিএডি’র পরিচালক ড. সলিমুল হক বলেন, এখন যে মাত্রায় শিল্পবর্জ্য তৈরি হচ্ছে তা কমাতে না পারলে অর্থনীতি টেকসই করা সম্ভব নয়। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে এই উদ্যোগ। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের সুনাম বাড়বে।
বিজিএমইএ’র পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় কারখানাগুলো ইতিমধ্যে সার্কুলার অর্থনীতি প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে। ডিএফআইড’র জ্যেষ্ঠ পরিবেশ উপদেষ্টা জন ওয়ারবার্টন বলেন, বাংলাদেশে সার্কুলার অর্থনীতি নিয়ে এখনও ব্যাপকভাবে কার্যক্রম শুরু হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কিত নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। সম্পাদনা : রাশিদ