ভারতে অক্সিজেনের হাহাকার টানা চারদিন শনাক্তে বিশ্ব রেকর্ড
অর্থনীতি ডেস্ক : টানা চতুর্থদিন ভারতে ৩ লাখের বেশি আক্রান্ত । একদিনে ২ হাজার ৭৬৭ মৃত্যু, আক্রান্ত ৩ লাখ ৪৯ হাজার আশঙ্কাজনকহারে বাড়তে থাকা এই শনাক্ত ও মৃত্যুহার খুব শীঘ্রই নেমে আসার সম্ভাবনা নেই। ভারত যখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত, অনেকের মনে তখন ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন- ভারতের শীর্ষ নেতারা এখন কোথায়? কী করছেন তারা?
মহামারির কারণে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ভারতের শশ্মানগুলোতে মৃতদেহ সৎকার হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর শুক্রবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো একদিনে বিশ্বের সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড গড়েছে ভারত। মধ্য মার্চে শুরু হওয়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে পড়ে এখন সীমাহীন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে ভারতীয় জনগণ। হাসপাতালে মিলছে না ঠাঁই, আইসিইউ, ওষুধপত্র, অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেটর নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম সংকট। মর্গজুড়ে এবং অন্তিম ক্রিয়ার অপেক্ষায় জমে উঠেছে লাশের স্তূপ।
আশঙ্কাজনকহারে বাড়তে থাকা এই শনাক্ত ও মৃত্যুহার খুব শীঘ্রই নেমে আসার সম্ভাবনা নেই। ভারত যখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত, অনেকের মনে তখন ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন- ভারতের শীর্ষ নেতারা এখন কোথায়? কী করছেন তারা?
মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ভারত এখন করোনা মহামারি সমাপ্তের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।
করোনার ধাক্কায় পর্যুদস্ত মহারাষ্ট্রসহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বারবার সতর্ক করে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ জানান। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে করোনা বিষয়ে নেতৃত্ব শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সপ্তাহখানেক আগেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ছিলেন একেবারেই নীরব। এপ্রিলজুড়ে বিভিন্ন বিবৃতিতে নরেন্দ্র মোদি জাতীয় টিকাদান কর্মসূচী নিয়ে বক্তব্য রাখেন। আশঙ্কাজনকহারে বাড়তে থাকা শনাক্তের বিষয়টি স্বীকার করলেও পদক্ষেপ গ্রহণে ছিল দ্রুততার অভাব। এমনকি রাজ্য সরকারগুলোর কাছেও শনাক্তকরণ পরীক্ষা বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, জনগণের প্রতিও ছিল না কোনো সতর্কবার্তা।
ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের স্বপ্রণোদিত লকডাউন ঘোষণা করা এবং হাসপাতালগুলোতে সংকট দেখা দেওয়া শুরু হলেও মোদি ভারতের সাফল্যের গান গাইতেই ব্যস্ত ছিলেন। ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রকাশিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মোদি জানান, ‘চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমাদের অভিজ্ঞতা, পুঁজি এবং ভ্যাকসিন মজুদ অপেক্ষাকৃত ভালো।’
অবশেষে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো দেশটির জরুরি পরিস্থিতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
রাতে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্যে নতুন পদক্ষেপের ঘোষণা দেন তিনি। মোদি বলেন, ‘মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল- তারপর এলো দ্বিতীয় ঢেউ।’ কিন্তু ততোক্ষণে, সংক্রমণ এতটাই তীব্র রূপ ধারণ করে, যে তা বিশ্ব রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী নতুন শনাক্তের প্রায় ২৮ শতাংশই ছিল ভারতের।
বাড়ছে ক্ষোভ : ২০১৯ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির তরফ থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মোদি। ভারতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এই নেতার অবস্থান। এমনকি গত বছর অন্যান্য বিশ্ব নেতারা মহামারি ব্যবস্থাপনা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে শিরোনামে জায়গা করে নিলেও একরকম পারই পেয়েছিলেন মোদি। হুট করে দেওয়া কঠোর লকডাউনে দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে গেলেও সেবার মোদির ওপর আসেনি কোনো আঁচ।
কিন্তু, এবারের পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় ভয়াবহ। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে আতঙ্কিত এবং দিশেহারা মানুষের পোস্টে ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ওষুধপত্র এবং হাসপাতাল শয্যা না পেয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ যারা আগে থেকেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিলেন তারাও এখন মাথা কুটছেন। অথচ, সময় থাকতে কেউ তা আমলে নেয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস পার্টির সদস্য মমতা ব্যানার্জী মোদির পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করেন। মোদি নিজে কোভিড নিয়ন্ত্রণে যেমন কিছু করেননি, তেমনি অন্যদেরকেও কিছু করতে দেননি বলে অভিযোগ তুলেন এই রাজনীকিবিদ।
বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, জনসাধারণ নিরাপত্তার ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত হওয়ার কারণেই সতর্ক অবস্থান থেকে সরে এসেছিল। আর সে কারণেই দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে গেছে। তবে, এই ভ্রান্ত আত্মতুষ্টিকে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। শীর্ষ এই নেতারা জনসমাগম এড়িয়ে চলার বিষয়ে কোনো ধরনের সতর্কবার্তাই প্রচার করেননি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখ লাখ পুণ্যার্থীদের সমাগমে সপ্তাহব্যাপী তীর্থযাত্রার পিছেও ছিল তাদের মৌন সমর্থন।
ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায় যখন মোদি মন্ত্রীদের সাথে সংক্রমণ বিষয়ক সভার মাঝ থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক র্যালিতে অংশ নেন। চারটি অঙ্গরাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে চলতে থাকা নির্বাচনকে ঘিরে চলেছে এই প্রচারণা। এর মধ্যে আছে মমতার নেতৃত্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যেখানে বিজেপি আগে কখনো জয়লাভ করেনি।
এবার পশ্চিমবঙ্গ ছিল বিজেপি এবং মোদির জন্য মূল আকর্ষণের স্থান। মার্চ ও এপ্রিল মাসে এই রাজ্যে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে একাধিক প্রচারণা র্যালি চালান তারা। অথচ, সংক্রমণ বাড়তে থাকলে অন্য অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী দল প্রচারণা কার্যক্রম থেকে সরে আসে। গত রবিবার ভারতের প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল কংগ্রেস এক বিবৃতিতে জানায় যে, তারা পশ্চিমবঙ্গে সকল জনসমাগমপূর্ণ প্রচারণা বাতিল করেছে। মমতা ব্যানার্জীও মহামারির কারণে তৃণমূলের সংক্ষিপ্ত সভার ঘোষণা দেন।
অন্যদিকে, বিজেপি ঘোষণা দেয় যে তারা সীমিত আকারে ৫০০ জনকে নিয়ে “ছোটখাটো গণ জমায়েত” আকারে প্রচারণা চালাবে। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গে মোদির এক প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার তা বাতিল করা হয়।
তবে, মার্চ এবং এপ্রিল জুড়ে চালানো প্রচারণা এবং দেরীতে এসে পদক্ষেপ গ্রহণ জনগণের প্রতি সতর্কবার্তাকে ক্ষুন্ন করেছে বলেই মনে করেন ভারতীয় সমাজকর্মী মানদের। ‘সবসময় সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু আমরা যা দেখেছি তা হল, প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতঅর্থেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে জড়ো করেছেন। রাজনৈতিক এসব সমাবেশ কেউ কোনো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দূরে থাকুক, মাস্ক পর্যন্ত পরিধান করেননি’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সূত্র : টিবিএস বাংলা অনলাইন, বাংলানিউজ, বিডিনিউজ