কৃষক কাটছে ধান, ফরিয়ারা দিচ্ছে গোঁফে তেল!
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
এখন দেশব্যাপী কৃষকরা বোরো ধান কাটেতে শুরু করেছ। এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকের মনে এখন আনন্দ আছে। আবহাওয়াও বেশ অনুকূলে। বন্যা, ঘূর্ণিঝর, বৃষ্টির কোনো পূর্ভাবাস এখনো শোনা যায়নি। তাছড়া কৃষকরা যার যার মতো করে ক্ষেতের ধান কেটে তোলায় ব্যস্ত আছেন। হাওড় এলাকায় ধান কাটার শ্রমিকের কিছু অভাব আছে। তবে কৃষিদপ্তর ধান কাটার বেশ কিছু যন্ত্র এবার কৃষকদের দিয়েছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বোরো ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধানকে কেন্দ্র করে কৃষকের যে আনন্দ সেটি প্রায় প্রতি বছরই নিরানন্দে পরিণত হয়। ধান সংগ্রহের জন্য সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করে সেটি অনেক সময় কৃষকের মনোপুত হয় না। আবার মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মূল্য ধার্য করা হলেও মধ্যেস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক ধার্যকৃত ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
মধ্যস্বত্বভোগীর মধ্যে ধান সংগ্রহকারীরাই যে শুধু থাকে তা নয় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা, মিলারসহ অনেকেই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরক্ষভাবে যুক্ত। তাদের ‘হিস্যা’ তারা যেকোনো মূলেই আদায় করে নেয়। ফলে কৃষক বঞ্চিত হয় ন্যায্য মূল্য থেকে। অনেক এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা কৃষক ও ফরিয়াদের মধ্যেস্থতায় থাকেন। কৃষক বা ফরিয়া কেউ তাদের এরিয়ে যেতে পারেন না। এভাবেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধান কাটার মৌসুমে ফরিয়া, মধ্যেস্বত্বভোগী, মিলার, দুর্নীতিবাজ কিছু সরকারি কর্মকর্তা ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করে। কৃষকরা তাদের কাছে অনেকটাই নিরুপায়। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো একেবারে-জানেন না তা কিন্তু নয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা দমন করার কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নিলেও সেটি খুব বেশি কার্যকর হয় না। অথচ কৃষকদের কাছ থেকে যদি ন্যায্য ধার্য মূল্যে সরকার সরাসরি ধান ক্রয় করতো তহলে কৃষকরা উপকৃত হতো।
কৃষরা ধান চাষ করে যদি লভবান হয় তাহলে দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ তারাই গ্রহণ করতে দ্বিধা করবে না। সময় এসেছে কৃষকদের স্বার্থরক্ষা করে এমন বিধি-বিধান ও আইনগত ব্যবস্থা সরকরারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা। সেটি করা না হলে কৃষকরা ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য হবে। তাছাড়া বর্তমানে ধান উৎপাদন ছাড়াও কৃষকদের অন্যান্য ফসল, শাক-সবজি, ফল-ফলাধি, বাগান ইত্যাদি চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষকের সামনে এখন চাষাবাদের বিষয় বাছাই করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সেটি অবশ্য দেশের কৃষি অর্থনীতির জন্য সামগ্রিকভাবে ভালো লক্ষণ কিন্তু সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে দেশে ধান উৎপাদন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাহলে বিদেশ থেকে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের চাইতে আমদানিকারকরাই বেশি লাভবান হবে এবং বাজারে চালের সংকট ঘন ঘন তৈরি হবে। সেটি সরকারের জন্য বিভ্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। সে কারণে সরকারকে পরিকল্পনা মোতাবেক ধান চাষের আধুনিকায়ন, বাজার ব্যবস্থা, মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ যাবতীয় বিষয়গুলো ঢেলে সাজাতে হবে।
মান্দাতা আমালের ধান চাষ, ফরিয়াদের ওপর কৃষকের নির্ভরশীলতা, বাজার ব্যবস্থাকে সিন্ডিকেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন অনেকটাই ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দেশের কৃষি ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার, আধুনিক যন্ত্র-প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা, ধান চাষের ওপর নির্ভর করার মতো পেশার গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি বিষয়। কৃষি যদি অন্য আট-দশটি লাভজনক পেশার মতো কৃষকের শুধু জীবন-জীবিকা নির্বাহই নয় অন্য সব কিছু উন্নত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে বর্তমান যুগে ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল কৃষি পেশা নানা সংকটের কারণে মুখ থুবরে পড়তে বাধ্য হবে। কৃষি ও কৃষকে দেশ ও জাতির স্বার্থে সয়ম্ভরভাবে ভবিষতের ওপর নির্ভর করার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে অকার্যকার করে দিতে হবে। তহলেই কৃষি, কৃষক এবং দেশের ভোক্তা-জনগণ খাদ্যর চাহিদা ও প্রকৃত মূল্য লাভে সন্তুষ্ট থাকতে পারবে। পরিচিতি : কলামিস্ট