প্রথম পাতা • মিনি কলাম • লিড ৪
কেনাকাটা না করতে বলার আগে ভাবতে হবে, কত বড় বিপর্যয়ে ফেলবো লাখ মানুষের জীবিকায়?
নাজনীন আহমেদ
বেশিরভাগ মানুষের হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু আবারও এরকম একটা পোস্ট দিতে হচ্ছে। দয়া করে পুরাটা পড়ে মন্তব্য করবেন। দুদিন ধরে বেশ সমালোচনা দেখছি, কেন মানুষ দোকানপাটে কেনাকাটা করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে। আচ্ছা ধরে নিন কেউ কেনাকাটা করতে গেলো না। সবাই এবার ঠিক করলো ঈদে কোনও কেনাকাটা করবে না। আমাদের কী ধারণা আছে কতো হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এই ঈদের সময়? কতো লক্ষ মানুষের খাওয়া পড়া, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ আসে এই দোকানপাট গুলো চলে বলে?
সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি হয়েছিলো ২০১৩ সালে। সেই অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য অনুযায়ী, আরও ৮ বছর আগে দেশের মোট হোলসেল ও রিটেইল এন্টারপ্রাইজ এর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩৫ লাখ ৯০ হাজার। আর এ সকল এন্টারপ্রাইজে কর্মরত ব্যক্তির সংখ্যা তখন ছিলো প্রায় ৮৪ লাখ। এখন এই সংখ্যা যে বহুগুণে বেড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আগের সংখ্যাও যদি ধরে নিই তাহলে এই ৮৪ লাখ ব্যক্তি, যারা এখানে কাজ করছেন তাদের পেছনে রয়েছে তাদের পরিবার। এক একটি পরিবারের ৪ জন সদস্য হলেও চিন্তা করে দেখুন কতো কোটি মানুষের আহার আর জীবিকা আসবে এইসব বেচাবিক্রি থেকে। আরও পেছনে গেলে এ সকল পণ্যের মধ্যে যেগুলো দেশে তৈরি হয়েছে তার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কতো লক্ষ লক্ষ কারিগর শ্রমিক রয়েছেন যাদের বেঁচে থাকার আয় আসবে এই বেচাবিক্রি থেকে। কাজেই কেনাকাটা না করতে বলার আগে ভাবতে হবে, কতো বড় বিপর্যয়ে ফেলবো লক্ষ মানুষের জীবিকা? (তবে একথা মেনে নিচ্ছি এসকল হোলসেলার রিটেইল দোকানের সবাই ঈদের পণ্য কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত নন তাই সংখ্যার কিছুটা হেরফের হতে পারে। তারপরও সংখ্যাটা যে অনেক বড় তাতে সন্দেহ নেই)।
হতদরিদ্র মানুষকে সাহায্য দেয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেখানে বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী হিসেবে যারা আছেন তেমন নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের কতো লক্ষ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাবেন, তাদের সন্তানরা অপুষ্টিতে পড়বে, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে তা কী আমরা ভেবে দেখেছি?
তার মানে কী, আমি বলছি যে সবাই দল বেধে শপিংয়ে চলে যাবো? না, তা বলছি না। বরং আমি বলছি, একদিকে করোনার ঝুঁকি যতোটা সম্ভব কম রাখা এবং লক্ষ কোটি মানুষের অন্নের সংস্থান ঠিক রাখা- এ দুয়ের একটি সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেক্ষেত্রে নি¤œলিখিত পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি।
[১] যাদের অনলাইন কেনাকাটা সম্ভব এমন দোকানে কেনাকাটার আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা রাখেন, তাদের কোনোভাবেই মার্কেটে যাওয়া ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে সরকার বড় বড় ব্র্যান্ডের কিছু কিছু দোকানকে বলে দিতে পারে শুধু অনলাইন কেনাকাটায় যুক্ত থাকতে। যেমন আমি কোন শপিং করতে বাইরে যাবো না। যা কিছু কেনার প্রয়োজন বোধ করি, তা অনেকদিন ধরেই অনলাইনে কিনে নিচ্ছি। ঈদের জন্য কিনলেও সেভাবেই কিনবো। [২] যারা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা ছাড়া ওপায় নেই, তাদেরকে আবশ্যিকভাবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ডাবল করে মাস্ক পড়তে হবে। এই বিষয়ে গণমাধ্যমে জোর প্রচারণা চালানো উচিত।
[৩] প্রত্যেকটা মার্কেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কড়া তদারকি থাকতে হবে, যাতে মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা থাকে। সেইসঙ্গে দোকানগুলোর প্রবেশ পথে হাত স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
[৪] কোনও দোকানে ভিড় দেখলে তা এড়িয়ে যেতে হবে।
[৫] বয়স্ক এবং শিশুদের সঙ্গে নিয়ে দোকানে যাওয়া যাবে না।
[৬] কেনাকাটা শেষে বাসায় গিয়ে কী করে শপিং করা জিনিসগুলোকে জীবাণুমুক্ত করবেন এবং নিজেরাও ভালোমতো হাত ধুয়ে গোসল করে জীবাণুমুক্ত হবেন সেই ধরনের প্রচারণা ব্যাপকভাবে থাকতে হবে। [৭] প্রতিটি মার্কেট এলাকায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে বারবার সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করতে হবে।
[৮] যেসব এলাকায় সম্ভব, সেখানে খোলা জায়গায় কেনাকাটা করতে হবে।
[৯] করোনা থেকে খুব সহজেই আমাদের মুক্তি নেই। ঈদ গেলে করোনা চলে যাচ্ছে না। কাজেই এই বাস্তবতায় আমরা কীভাবে চলবো তা ভাবতে হবে।
[১০] বড় বড় মেগা মল গুলো তাদের অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যাতে সেখান থেকে কেনাকাটা করা যায়।
[১১] শপিং করার সময় বাড়াতে হবে, কারণ অল্প সময়ের জন্য দোকানপাট খোলা থাকলে ভিড় বেশি হয়।
[১২] সরকার যেহেতু শপিংমল খুলে দিয়েছেন, তাই এই সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা জোরদার করতে হবে । দোকান মালিকদের পক্ষ থেকেও এই প্রচার প্রচারণায় অংশ নিতে হবে।
[১৩] মাস্ক ছাড়া যাদেরকে দোকানে দেখা যাবে, তাদের জরিমানা অনেক বেশি করতে হবে। প্রত্যেক দোকানে মাস্ক রাখতে হবে। যাতে মাস্ক ছাড়া কেউ আসলে তাকে সেটা তারা দিতে পারেন। বাস্তবতার নিরিখে আমাদের ভাবতে হবে। খুব ভালো হতো যদি এক বছর সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারতাম আর অনায়াসে খাবার-দাবার জীবিকার সব সংস্থান হয়ে যেতো। তা যখন সম্ভব নয়, তখন অনেক পরিবারের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে এবং তাদের বাঁচিয়ে রাখতে বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে। সেই আলোকে চলুন, মানুষকে সচেতন করি। অহেতুক বাইরে যাওয়া, ঘোরাঘুরি সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখি। যারা অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারেন তারা যেন দোকানে গিয়ে ভিড় না করেন। কিন্তু প্রয়োজনে বাইরে গেলে নিজ থেকে কী করে তারা সচেতন থাকবেন, সেই কথাগুলো বারবার বলতে থাকি। লেখক : বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। সূত্র : ফেসুবক