আমার দেশ • নগর সংস্করণ • প্রথম পাতা • লিড ১
আট বছরে দেশে লিচু চাষের জমি ও ফলন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ
মতিনুজ্জামান মিটু : অচিরেই বাজারে আসা শুরু হবে। মধ্য মে থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের বাজার ভরে যাবে টকটকে রাঙা লিচুতে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মৌসুমে দেশের ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৪৩০টি থেকে ৯৫ লাখ ৭ হাজার টি গাছে ৩১৩০ কোটি ৯৭ লাখ ২০ হাজার থেকে ৩৮০২ কোটি ৮০ লাখ লিচু হবে। প্রতিটি লিচু সর্বনিম্ন দাম ১.৫০ টাকা হারে যার দাম হবে ৪৬৯৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ৫৭০৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের একটি সূত্র জানান, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে লিচু গাছের আবাদ ও উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৩৯১ হেক্টর জমির গাছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০৯ টন লিচু হয়েছিলো। যা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩১ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমির গাছে হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৮৩০ টন।
দেশের সর্বত্র দেখা গেলেও সবচেয়ে ভালো লিচু হয় দিনাজপুরসহ রাজশাহী অঞ্চলে। লাভজন হওয়ায় বেড়ে চলেছে লিচুর বাাগন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. তৌহিদুল ইসলাম ও এডিডি (উদ্যান) কৃষিবিদ মো. জাফর ইকবাল বলেন, এ জেলায় ২০১২ সালে ১৫০০ হেক্টর জমিতে লিচুর গাছ ছিলো ৩ লাখ ৭০হাজার ৫০০টি। যা বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫,৬১০ হেক্টর ও ১৬ লাখ ৮৩ হাজার টি। কর্মকর্তাদ্বয় একই সুরে বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার লিচুর দাম ও ফলন দুইই ভালো পাওয়া যাবে। এখানে লিচু গুটি পর্যায়ে রয়েছে। গত মৌসুমের বৃষ্টির কারণে চলতি মৌসুমে বোম্বাই এর ফলন কিছুটা কম হলেও চায়না-৩, বেদানা ও মাদ্রাজীসহ অন্যান্য জাতের লিচু ভালো হবে। এখানে প্রতি ১০০টি লিচু ১৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। বেদানা জাতের লিচু বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এখানে অল্প সংখ্যক নাবী জাতের লিচু হয়। মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে পাকা লিচু বাজারে আসবে।
হেক্টরে ২৪৭টি থেকে ৩০০টি লিচু গাছের চাষ করা যায়। সার, নিড়ানী, সেচ ও বালাই নাশকসহ অন্যান্যতে খরচ হয় ৩৫,০০০টাকা। লিচু চাষে সব খরচ বাদে একরে (০.৪০৫ হেক্টর) গড়ে লাভ ৩ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) এর প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, খরায় কিছু ঝরে গেলেও ফলন ভালো হবে। দিনাজপুর এবং ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গুণমানের লিচু হবে। পুষ্টি ও পথ্যবিদদের বরাতে তিনি জানান, লিচুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। যেটি রক্ত ও নালীর চাপ কমিয়ে রক্তের স্বাভাবিক গতি বাড়িয়ে থাকে। লিচু খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে থাকায় এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস থেকে রক্ষা করে।
লিচু দেখতে সুন্দর, পুষ্টিগুণও ষোলো আনা। খেতে সুস্বাদু। একসঙ্গে খুব বেশি খেলে ফল ভালো নাও হতে পারে। খাওয়া পরিমাণে বেশি হলে কারও কারও অ্যাসিডিটি আবার কখনো ডায়রিয়াও হতে পারে। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের লিচু হিসাব করে খাওয়া ভালো। খেলে সর্বোচ্চ চারটি থেকে পাঁচটির মধ্যেই থাকা উচিত।
হিসাবে দেখা যায়, ১০০ গ্রাম লিচুতে শক্তির পরিমাণ ৬৬ কিলোক্যালরি, শর্করা ১৬.৫৩ গ্রাম, প্রোটিন ০.৮৩ গ্রাম, চর্বি ০.৪৪ গ্রাম, আঁশ ১.৩ গ্রাম। সেই সঙ্গে লিচু অসংখ্য ভিটামিন আর মিনারেলে সমৃদ্ধ। লিচুতে থাকা ভিটামিন সি, নিয়াসিন, থায়ামিন চুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে চুলকে দিঘল কালো করে তোলে। ক্যালরি বেশি থাকায় শরীরের কর্মক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এই ফল।
অত্যধিক ক্লান্তিতে বা দীর্ঘ রোগভোগের পর দুর্বলতায় প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি লিচু সামান্য লবণ মিশিয়ে খেলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের দুর্বলতায় স্মৃতিবিভ্রম ঘটলে, ভুলো মনের মানুষজন দিনে আট দশটা লিচু লবণ মিশিয়ে খেলে স্মৃতি স্বাভাবিক হয়। মৌসুমের সময় দু-বেলা চার-পাঁচটি করে লিচু খেলে বয়স বাড়লেও শরীরে লাবণ্য বজায় থাকে। পরিবেশদূষণে দ্রুত শরীরে বয়সের ছাপ পড়ছে। লিচু শরীরের তারুণ্য ধরে রাখার মোক্ষম অস্ত্র। লিচুতে আছে ক্যানসার প্রতিরোধক্ষমতা। লিচু ক্যানসার কোষ বিভাজনকে বাধা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে লিচুতে থাকা উপাদানগুলো। লিচু খেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। লিচু হজমশক্তি বাড়ায়। সেই সঙ্গে ক্ষুধাবর্ধক হিসেবেও কাজ করে। সুস্থ হাড়ের জন্য লিচু অতি প্রয়োজনীয়। হাড়ের সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য ওষুধের বিকল্প এ ফলটি। লিচু ত্বক ভালো রাখে। ব্রণ হতে বাধা দেয়। সেই সঙ্গে ত্বকের কালো দাগ দূর করার ক্ষক্ষমতা আছে লিচুর।
লিচুর জলীয় অংশ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। লিচুতে থাকা ভিটামিন ‘সি’-এর পরিমাণ কমলালেবুর তুলনায় ঢের বেশি। এ ছাড়া, গাজরের তুলনায়ও অনেকটা বেশি বিটা ক্যারোটিন থাকে লিচুতে। মুখের স্বাস্থ্য এবং দাঁত ভালো রাখতে লিচুর আছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। লিচুর ভিটামিন ‘এ’ রাতকানাসহ চোখের নানা রোগের প্রতিষেধকও। এ রোদ-গরমের সময়ে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে শরীরকে রক্ষা করে লিচু। ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকে, তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের পরিমিতভাবে লিচু খাওয়া উচিত। বোলতা, বিছে কামড়ালে এর পাতার রস ব্যবহার করা যায়। কাঁশি, পেটব্যাথা, টিউমার এবং গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি দমনে লিচু ফল কার্যকর।
অনেক জাতের লিচুর মধ্যে বেদানা, গুটি, মাদ্রাজি, বোম্বাই, মঙ্গলবাড়ী, মোজাফফরপুরী, চায়না-৩, কদমী সবচেয়ে ভাল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ৩টি লিচুর জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হচ্ছে: বারি লিচু-১, বারি লিচু-২ ও বারি লিচু-৩। বোম্বাই লিচু টকটকে লাল, মাদ্রাজি আগাম জাত, সবচেয়ে ভালো জাত চায়না-৩।
বারি লিচু-১: ফল ডিম্বাকার এবং রঙ লাল। দেশের উত্তারাঞ্চলে এ জাতটি চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ জাতটি আগাম জাত। বারি লিচু-২: বীজ অপেক্ষাকৃত বড়। প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয়। জাতটি বাংলাদেশের সর্বত্রই চাষ করা যায়। বারি লিচু-৩: মাঝ মৌসুমী জাত, নিয়মিত ফল ধরে। গোলাপের সুঘ্রান বিশিষ্ট অপেক্ষাকৃত বড় আকারের ফল উৎপাদনকারী এ জাতটি বসতবাড়ীর বাগানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ফলের শাঁস মাংসল রসালো ও মিষ্টি। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও, রেজা