ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ খসড়া প্রবিধানমালায় সংশোধন চাওয়া হয়েছে
মো. আখতারুজ্জামান : জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা ২০২১ শীর্ষক খসড়া প্রবিধানমালা সর্ব সাধারণের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সব ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ ভোক্তাসাধারণের কাছ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে মতামতা চাওয়া হয়েছিলো। খসড়া প্রবিধানমালায় বেশকিছু সংশোধনি চেয়ে মতামত এসেছে বলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এ সব মতামত লিখিত ও ই-মেইলের মাধ্যমে করা হয়েছে। তবে বড় ধরনের কোনো সংশোধন করা হবে না বলে জানা গেছে।
ট্রান্স ফ্যাট বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্য দ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে কমিয়ে আনার জন্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আমরা এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে খসড়া প্রবিধানমালাটি প্রণয়ন করেছি। ইতোমধ্যে খসড়া প্রবিধানের উপর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো মতামত থাকলে তা চাওয়া হয়েছিলো। কিছু মতামত এসেছে। সেই মতামতের আলোকে কিছু পরিবর্তন করা হবে।
তিনি বলেন, সংশোধন করা হবে তবে বড় ধরনের তেমন কোনো পরিবর্তন করা হবে না। যেমন মতামতে সময় চাওয়া হয়েছে আমরা চাইলেও তো আর সময় পিছিয়ে দিতে পারি না। কারণ দেশের খাদ্য পণ্যে ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা ২ শতাংশের নিচে নিয়ে আসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা রয়েছে। আমরা খুব দ্রুত সময়ে খসড়া প্রবিধানমালাটি সংশোধন করে তাই খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিবো।
২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রান্স ফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সকল তেল, চর্বি এবং খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট এর সীমা বেঁধে দিয়ে তা সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করার উদ্যোগ নিচ্ছে যা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ অধিশাখার অতিরিক্ত সচিব ড. অনিমা রানী নাথ বলেন, মতামত চাওয়া হয়েছে। সেখানে কিছু মতামত এসেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সেগুলো পর্যালোচনা করে যদি কোনো কিছু পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হয় করে আমাদের কাছে পাঠাবে। আমরা সেটা আবার পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠাবো। আশা করা হচ্ছে খুই শিগগিরই খসড়া প্রবিধানমালা আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠাতে পারবো।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও মৃত্যু ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকসহ, স্ট্রোক ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। যাদের হার্টে সমস্যার রয়েছে করোনাকালীন তাদেরকে একটু বেশি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, খাদ্য থেকে যত দ্রুত ট্রান্স ফ্যাট কমানো যায় ততো ভালো। সরকার ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে আইন করতে যাচ্ছে এটা ভালো উদ্যোগ। এটা একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই সরকার দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিতে পরে যেসব কোম্পানি ট্রান্স ফ্যাট উৎপাদন করতে তাদেরকে বিশেষ নোটিশের মাধ্যমে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার বিষয়ে বলতে পারে। এতে করে এটা ভালো ফল পাওয়া যাবে।
খাদ্য দ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১-এ বলা হয়েছে রুমিন্যান্ট বা প্রাণিজ উৎসজাত টিএফএ বাদে চর্বির ইমালসনসহ যেকোনো তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যেকোনো খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যেকোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) অথবা যেকোনো খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রামের অধিক টিএফএ থাকলে তা বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানি করা যাবে না।
২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে শুধুমাত্র ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে বছরে অন্তত ৫৭৭৬ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ৪৮০ জন। তাই যতই বিলম্বিত হচ্ছে ট্রান্সফ্যাটের নিয়ন্ত্রণ, ততই বেড়ে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত অথচ প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা।
খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস পারসিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেই সুপরিচিত। সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স এবং হোটেল রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে পিএইচও বা ডালডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও বা ডালডা ব্র্যান্ডগুলোর মোট ২৪ নমুনা বিশ্লেষণ করে পরিচালিত সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফল বলেছে ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া গেছে।
শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সব ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা, অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল পিএইচও’র উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্পাদনা : রেজা