অল্প খরচ ও কম সময়ে বেশি লাভ মৌসুম ছাড়াও বাড়ছে বছরব্যাপী তরমুজের চাষ
মতিনুজ্জামান মিটু : বার হাজার টাকা থেকে পনর হাজার টাকা খরচের ৩৩ শতকের এক বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায়। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় সাইজ কিছুটা ছোট হয়েছে। বেপারিরা সরেজমিনে যেয়ে দরাদারি করে ক্ষেত ধরেই বা সংখ্যা হিসেবে নগদ টাকায় কিনে ট্রাকে করে আনছেন দেশের নগর মহানগরের আড়তগুলোতে। আড়ত ও ট্রাক থেকে এই তরমুজ বিক্রি করা হচ্ছে কেজি হিসেবে। এবছর ক্ষেতে প্রতি ১০০ তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১২,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকায়। অন্য বছর প্রতিটির ওজন ২ কেজি থেকে ২০ কেজি হলেও এবছর বৃষ্টির অভাবে ১৫ থেকে ১৬ কেজিতে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপকুলীয় এলাকায় তরমুজের পরীক্ষামূলক উৎপাদন কর্মসূচির (পাইলট প্রোডাকশন প্রোগ্রাম) পিডি কামরুজ্জামান বলেন, আমন ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে কৃষক অনেক আশা নিয়ে তরমুজ লাগায়। কর্মসূচির আওতায় কয়রা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের ১০ জন কৃষক এলাকার ৫০ বিঘা জমিতে পাকিজা জাতের তরমুজের আবাদ করেন। কিন্তু আট মাসেরও বেশি সময় বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন একটু কম হয়। তবুও বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হন। এবার কয়রা উপজেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে পাকিজা ছাড়াও ড্রাগন, ফিল্ড, মাস্টার ও কালোমানিকসহ বিভিন্ন নামের তরমুজের চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষিবিদ মো. মোছাদ্দেক হোসেন হোসেন বলেন, অল্প খরচে কম সময়ে বেশি লাভ হওয়ায় ঘেরের পাড়সহ এই অঞ্চলে তরমুজের চাষ বাড়ছে। এবার ডুমুরিয়ায় ২৩০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। এখানে পাকিজা, ড্রাগন, বিগ ফ্যামিলি, হান্টার, জাম্বু জাগুয়া ও বাদশা নামের তরমুজের জাতের আবাদ হয়েছে। বিদেশ বিশেষ করে জাপান থেকে আমদানি করা হাইব্রিড জাতের তরমুজের এই বীজ কৃষকরা আবাদ করছে। এখন মাঠে তরমুজ রয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আবারও লাগানো হবে তরমুজ। ৪৫ দিন অন্তর তরমুজের চাষ করা যায়। এখানকার ঘেরের পাড়ে তরমুজের আবাদ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঘেরে পাড়ের ১৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হতো। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০০ হেক্টর থেকে ৮০০ হেক্টর। তরমুজ চাষে এখানকার মানুষ এখন প্রচন্ড আগ্রহী। তাই দিনে দিনে বাড়ছে তরমুজের আবাদ।
তবুও শূন্য রপ্তানির এই দেশে আমদানি হয় ৩২.২৮১ মেট্রিক টন তরমুজ। ২০১৬-১৭ এর চেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন তরমুজ কম উৎপাদন হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৫ হাজার ৭৪২ হেক্টর জমিতে ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৯ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হলেও ২০১৯-২০ তে ৩৮ হাজার ৮২৪ হেক্টরে ফলে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৯২ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, প্রাকৃতিকসহ নানা কারণে প্রতি বছর তরমুজ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। কোনো বছরে কমে এবং কোনো বছরে বাড়ে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৮ হাজার ১৩৬ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৭৪ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছিলো। পরবর্তিতে ২০১৩-১৪ তে ৪৩ হাজার ৫৩৫ হেক্টরে ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯৮৭ টন, ২০১৪-১৫ তে ৪৬ হাজার ৩৮০ হেক্টরে ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন ও ২০১৫-১৬ তে ৪৩ হাজার ৫৫৫ হেক্টরে ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩১০ টন তরমুজ উৎপাদন হয়। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৩৭ হেক্টরে ১৬ লাখ ৯১ হাজার ২০৪ টন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ হাজার ৬০৭ হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়।
বছর ব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) এর প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, অতিবৃষ্টিতে জমি তৈরি করতে না পারায় চর অঞ্চলসহ দেশের কোনো কোনো এলাকায় আবাদ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় তরমুজ উৎপাদন কম হয়। চলতি বছরে দেশে তরমুজের উৎপাদন ২০ লাখ টনেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তরমুজ এখন আর শুধু মৌসুমী ফল নয়। আগে শুধু গ্রীষ্মকালে পাওয়া গেলেও এখন সারা বছরই তরমুজ উৎপাদন হয়। এখন জমি ছাড়াও এক হাত উঁচু মাচায় তরমুজ উৎপাদন হয়। লোনা মাটির ঘেরের পাড় এবং চরাঞ্চলেও তরমুজ উৎপাদন হয়। সর্বত্র হলেও ইদানিং চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোর, খুলনা, বি.বাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তরমুজ হতে দেখা যাচ্ছে। চীন, জাপান ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বীজেই এখন কৃষকের আগ্রহ বেশি। এসব দেশের তরমুজের জাতই এখন সারা দেশে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে মহানগরের সর্বত্র ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে সব রং এর তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। সম্পাদনা : রেজা