তেল গ্যাস অনুসন্ধানে জাতীয় অগ্রাধিকার ঠিক করার তাগিদ
অর্থনীতি ডেস্ক : বাংলাদেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজে গতি আনতে নিজস্ব অর্থায়নে একক বাপেক্স নির্ভরতায় সম্ভব নয়। বরং স্থল ও সাগরে অনুসন্ধানে পিএসসি অধীনে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে আনতে হবে, বাপেক্সকেও কাজ করতে হবে একক ও যৌথ উদ্যোগে। আর কার্যকরভাবে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সর্বপরি আইওসির বিনিয়োগ আকর্ষণে গ্যাসের দামে ক্যাপিং পদ্ধতির বদলে ফমূর্লা নির্ভর পদ্ধতিতে যেতে হবে। নইলে কোনো কোপিলিপস বা দেউও এর মতো পিএসসি স্বাক্ষরে বাড়তি দাম পাওয়ার নেগোসিয়েশনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। সর্বপরি সাগরের মাল্টি ক্লায়েন্ট ডাটার জন্য অপেক্ষা না থেকে হাতে থাকা তথ্য উপাত্তের উপর নির্ভর করে স্থল ও সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে প্রস্তাব আহ্বান করা উচিত। এনার্জি এন্ড পাওয়ার আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বক্তারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
আলোচনায় একজন বক্তা অভিযোগ করেছেন দেশে গ্যাস নেই এমন আলোচনা তুলে এলএনজি আমদানীর পথ পরিষ্কার করা হয়েছে। যেমনটি ইউনোকলের প্রস্তাব অনুসারে ভারতে গ্যাস রপ্তানির জন্য প্রচার করা হয়েছিল বাংলাদেশ গ্যাসের উপর ভাসছে। অপর এক বক্তা দাবি করেন সরকারের প্রচলিত নিয়মে ডিপিপি অনুমোদন করে আর যাই হোক তেল গ্যাস অনুসন্ধান করা যাবে না। অভিযোগ করা হয়, আমলাতন্ত্রের অতি হস্তক্ষেপের কারণেই পঙ্গু হয়ে পড়েছে বাপেক্স, অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে পেট্রোবাংলা। এর জবাবে বলা হয়, পেট্রোবাংলা ও কোম্পানিগুলোতে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে না পারার কারণেই আজকের অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি খাতে কর্মরত ও অবসরে যাওয়া বিশেষজ্ঞরা এই দায় এড়াতে পারেন না।
গত শনিবার ‘পোস্ট কোভিড হাইড্রোকার্বন এক্সপ্লোরেশন চ্যালেঞ্জেস ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এমটুকে ইপি টকস সঞ্চালনা করেন এনার্জি এন্ড পাওয়ার সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরামর্শক ইঞ্জি খন্দকার আবদুস সালেক। আলোচনায় অংশ নেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবুল মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব বিভাগের সম্মানিত প্রফেসর ড. বদরুল ইমাম, পেট্রোবাংলা ও বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মোকতাদির আলী, ইউএমসি বাংলাদেশ অপারেশনের সাবেক ভিপি ফরিদউদ্দিন ও বাপেক্সর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুর্তজা আহমেদ ফারুক।
আবুল মনসুর প্রশ্ন করেন, কেবল কী আমলাতন্ত্রের সিদ্ধান্তহীনতায় দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজকে আটকে দিয়েছে। এমনটি বোধ হয় বলা ঠিক হবেনা। কেননা বর্তমান সরকার সবসময় বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কারিগরি খাতে কাজ করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিশেষজ্ঞদের মতামতর বদলে যাওয়ার বিষয়টি সরকারকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছে। নিজস্ব গ্যাসের জোগান বৃদ্ধিতে অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই। তবে পোস্ট কভিড সময়কালে সরকার অনুসন্ধান খাতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে সক্ষম হবে তা এখনই বলা যাবে না। এটাও মনে রাখতে হবে জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোতে ব্যবস্থাপনা অদক্ষতাও এখন অনেক। ফলে অর্থায়ন পেলেও কাজ কতটা হবে সেটা ভেবে দেখতে হবে। প্রফেসর বদরুল ইমাম দাবি করেন, নিজেদের কাজের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য গ্যাস খাত নিয়ে বির্তক তৈরি করা হয়। এলএনজি আমদানী করার স্বার্থে গ্যাস নেই এমন বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেন, উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কারণেই বাপেক্সের আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাপেক্সের আবিষ্কার ভোলা গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নের কাজ গ্যাজপ্রমকে দিয়ে দেয়া হবে একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আইওসির বিনিয়োগ আনতে হবে কিন্তু কোনোভাবেই বাপেক্সকে বাদ দিয়ে নয়।
মোকতাদির আলী বলেন, ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হলে গ্যাসের মজুদ বাড়াতে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনুসন্ধানের জন্য আজও দেশে একটি সাসটেনেবল নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। মনে রাখতে হবে বিনিয়োগকারীরা আসবে লাভের জন্য, সেবা করার জন্য নয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কখনই পিএসসিতে গ্যাসের প্রতিযোগিতামূলক দাম ঘোষণা করা যায়নি। ফলে কখনো কখনো আইওসিরা আসলেও আবার দাম বাড়ানোর ইস্যুতে দেন দরবার করে ফিরে গেছে। পেট্রোবাংলার কাছে যে তথ্য উপাত্ত আছে তা উন্মুক্ত করে আইওসিরদের কাছ থেকে বিনিয়োগ আহ্বান করা উচিত।
ফরিদউদ্দিন বলেন, অনুসন্ধান থেকে দ্রুততার সাথে ফলাফল পাওয়ার জন্য পাবর্ত চট্টগ্রাম হাইড্রোকার্বন ডেভলপমেন্ট প্লান চূড়ান্ত করা উচিত। এখানে বেশ কিছু সম্ভবনায় কাঠামো আছে। যেখানে কাজ করে দ্রুত ফল পাওয়া যেতে পারে। বাপেক্স এখন একটি খোড়া কোম্পানি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থপনা থেকে আর যাই হোক তাদের পক্ষে অনুসন্ধান কাজ করা সম্ভব নয়।
মুর্তজা আহমেদ ফারুক বলেন, বাপেক্স নিজস্ব সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করতে পানেরনা। বরং জ্বালানি বিভাগ থেকে তাদের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের আরো স্বাধীনতা দেয়া জরুরি। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন, দেশে অনুসন্ধান কাজের দায় এককভাবে বাপেক্স সামাল দিতে সক্ষম হবে না। তাই আইওসিদের বিনিয়োগ আনতে হবে। বিশেষ করে স্থলভাগের পশ্চিমাঞ্চল ও গভীর কাঠামোতে অনুসন্ধানে এর কোনো বিকল্প নেই।
ইঞ্জি খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, নিজস্ব গ্যাসের জোগান বাড়াতে না পারলে কেবল এলএনজি আমদানী জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আর সেটার জন্য আইওসিদের আকর্ষন করার মতো নীতি হাতে নিতে হবে। আর এটা শুরুর করার জন্য মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই, হাতে থাকা ডাটা ব্যবহার করেই তা করা সম্ভব। তবে পিএসসি দলিলে গ্যাসের দামের যে ক্যাপিং করা আছে তা বদলাতে হবে। বরং পিএসসি জন্য একটি প্রাইসিং ফর্মূলা যুক্ত করতে হবে। যার আলোকে অনুসন্ধান শুরুর ৮/১০ বছর পর যখন উৎপাদন শুরু হবে তখন দাম নির্ধারণ করা যাবে। সরকারের উচিত তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য এখনই একটি জাতীয় অগ্রাধিকার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। যার আওতায় কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হলেই বাপেক্স, আইওসি, পিএসসি ও জয়েন ভেঞ্চার সব উদ্যোগ মিলিয়ে একই সাথে কমপক্ষে ১০টি রিগকে অপারেশনাল করা। আর এগুলো করতে না পারলে আগামী ৫/৬ বছরের মধ্যে দেশকে বড় ধরনের গ্যাস সংকটে পড়তে হবে। সম্পাদনা : রেজা