দেশে প্রতিবছর উৎপাদিত হয় ৪৭ লাখ টন ফল
মতিনুজ্জামান মিটু : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের (২য় সংশোধিত) প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. মেহেদী মাসুদ জানান, সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে ফলের উৎপাদন ও উন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ একটি আর্দ্র ও উষ্ণম-লীয় দেশ। এখানে আম, কলা, পেঁপে, সফেদা, আনারস, লিচু, কমলা, জাম্বুরা, পেয়ারা, নারিকেল, বাদাম, কাজুবাদাম, বেদানা, জাম, কাঁঠাল, খেঁজুর ইত্যাদি ফল ভালোভাবে জন্মে। তাই এসব ফলের চাষ করে স্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে বছরে ৩.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে মোট ৪৭.০ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয়। কিন্তু দেশে ফলের বাৎসরিক চাহিদা রয়েছে ৬৭.১৭ লাখ টন।
উল্লেখ্য, দেশে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু খায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম। চাহিদার শতকরা ৬৫ ভাগ ফল উৎপাদন হয় দেশে। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বাকি ৩৫ ভাগ আমদানি করতে হয়। অথচ বাংলাদেশ আবহাওয়ায় ৭০ ধরনেরও বেশি জাতের ফল চাষের জন্য উপযোগী, যা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বিরল। তাইতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, ‘এদেশের মাটি খাঁটি সোনা, এখানে যে কোন বীজ পুঁতে রাখলে চারা গজাবেই’।
তাই ফল চাষ সম্প্রসারণের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির অভাব দূরীকরণ, অধিক আয়ের সুরাহা, ফলের চাহিদা পূরণ ও পরিবেশের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের ফল চাষ সম্প্রসারণ ব্যবস্থা জোরদার করা একান্ত দরকার। সারাদেশে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারগুলো, নার্সারি, উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো ফলের নতুন জাতের উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ সারা বছর বিভিন্ন ধরনের দেশি ও বিদেশি জাতের ফলের প্রচলন ও সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা ও নির্দেশনায় দেশি ও অপ্রচলিত ফল চাষ যেমন- টক কুল, তেঁতুল, আমলকী, জাম, কদবেল, দেশি আমড়া, বীজবিহীন লেবু, কাঁটাবিহীন লেবু প্রভৃতি সম্প্রসারণেও আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল চারা, ভারত হতে ৬ হাজার ডিজে সম্পূর্ণা হাইব্রিড জাতের নারিকেল চারা এবং টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত আরবি খেজুরের চারা আমদানি করা হয়েছে, জাতগুলো হলো- আজুয়া, মরিয়ম, বারহি, লুলু, সুলতানা, মেডজল, ডেগলেট নুর, নিমেশি, শিশি, আনবারাহ ইত্যাদি এবং সব চারা সারা দেশে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ ও উপকূলীয় এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। স্মরণীয় অতীত থেকেই ফল প্রতিটি মানুষের সুখাদ্য হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বছর আগে খেঁজুরের চাষ এর সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়া বিহারে দারভাংগার কাছে স¤্রাট আকবর একলাখ আমগাছের বাগান ‘লাখ বাগ’ তৈরি, পর্তুগিজদের দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আনারস ও পেঁপের প্রর্বতন ইত্যাদি থেকেই বুঝা যায় ফলের প্রতি মানুষের কদর কি রকম ছিল। বিভিন্ন পৌরাণিক সাহিত্য ও ধর্মীয় গ্রন্থাবলি থেকেও ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা যায়। পবিত্র হাদিস শরিফে আছে ‘ফলের গাছ লাগানো সদকায়ে জারিয়া’ হিসেবে গণ্য হবে। খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোন খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায় কিন্তু দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না।
বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ঘাটতি পূরণ হলেও পুষ্টি সমস্যা অনেক প্রকট। ফলে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ পুষ্টিহীনতার কারণে নানা ধরনের রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশি। পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকাংশ ফলই সুস্বাদু, পুষ্টিকর, মুখরোচক ও তৃপ্তিদায়ক।
পুষ্টিকর খাবারের ওপর নির্ভর করে জীবনের অস্তিত্ব, কর্মদক্ষতা, মেধাবৃত্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি। পুষ্টি সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি অনেকেই মোটেই সজাগ নয়। ফলে যারা পেট ভরে দুবেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতার ভুুগছে তা নয়, সেই সঙ্গে ধনীরাও অপুষ্টির শিকার থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না। অবশ্যই বর্তমানে মানুষজনের সচেতনতা বেড়েছে।
ফল বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় ও উপযোগী উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল, রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় দেশি ফলগুলো খুবই অর্থবহ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ফলে সব ধরনের খাদ্যোপাদানই পাওয়া যায়। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের প্রধান উৎস হলো দেশীয় ফল। এছাড়া বর্তমানে আম, ড্রাগন, মাল্টা, আরবি খেজুর, ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারিকেল, থাই পেয়ারা, অ্যারভাক্যাডো ও পার্সিমনসহ পুষ্টি মানে সমৃদ্ধ বিভিন্ন ধরনের বিদেশি উন্নতজাতের ফলের চাষ অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যে ও ভিটামিন ও মিনারেলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য উপাদান হিসাবে ধরা হয়। এ ধরনের পুষ্টি উপাদান তথা হরেক রকম ফল ভক্ষণে রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হজম, পরিপাক, বিপাক রুচিবৃদ্ধি ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফল কাঁচা বা পাকা অবস্থায় সরাসরি খাওয়া হয়। ফল রান্নাছাড়া সবসময় খাওয়া যায় তাই এতে থাকা সবটুকু পুষ্টি পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান এ্যান্থোসায়ানিন, লাইকোপেন ও এন্টি অক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকায় মরণ ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফলের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষের খাদ্য, ভিটামিন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধন, পরিবেশ দূষণ রোধ, কাঠের যোগান, পশুপাখির খাবার সর্বোপরি আয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্নমুখী সুবিধা ফল গাছ থেকে পাওয়া যায়। ফল উৎপাদন ও তা পরিমাণ মতো আহারের সুযোগের অভাবে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ এখনও সম্ভব হয়নি।
দেশে যেসব ফল উৎপাদন হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয় জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে, শীতকালে ফল প্রাপ্তির সুযোগ কম এবং এ সময় উৎপাদিত ফলের দামও বেশি। এজন্য এ সময়ে মানুষের মাঝে ভিটামিন ও মিনারেলস এর অভাব বেশি দেখা যায়। এ কারণে শীতকালে যেসব ফল (কুল, কলা, পেঁপে, তেঁতুল) উৎপাদন সুবিধা আছে সেগুলোর চাষাবাদে অধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার। এছাড়াও বাংলাদেশে চাষ উপযোগী বিদেশি জাতের ফল আবাদের পরিমাণ বাড়িয়ে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন ফলের প্রাপ্যতা বা সরবরাহ সময়কাল বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে। যেমন- কাঁঠাল পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট, আম পাওয়া যায় এপ্রিল থেকে আগস্ট, পেয়ারা মে, জুন, জুলাই এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে। আশার কথা হলো বর্তমানে এই চিত্র অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে যেমন- পেয়ারা সারা বছর পাওয়া যায়, আম ০৮ মাস পাওয়া যায়। সময় উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ফল উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে বাংলার মানুষ আশার আলো দেখছে। সম্পাদনা : প্রিয়াংকা