৪৪ দেশে ছড়িয়েছে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় ৪২০৫ জনের মৃত্যু সংক্রমণের মাত্রা ভারতের অর্ধেক হলেও ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা
ফাতেমা আহমেদ : ভারতে গত অক্টোবরে করোনার বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তা বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
চলতি সপ্তাহেই হু করোনার এই বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে সতর্ক করেছে। ভারতের পর এই ভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা গেছে যুক্তরাজ্যে।
হু এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতে এত দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের ক্ষমতা। এই প্রজাতি অনেক দ্রুত ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম। এমনকি করোনার টিকার মাধ্যমে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সেই অ্যান্টিবডিও অনেক সময় এই ভাইরাসকে রুখতে ব্যর্থ হয়। ফলে টিকা নেয়ার পরেও অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
সেই সঙ্গে আরও যে সব দেশে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে সেসব দেশকেও সতর্ক করে হু বলেছে, এই ভ্যারিয়েন্টটি প্রথম ভারতে পাওয়া গেলেও এখন বিশ্বের ৪৪টি দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই প্রজাতির সংক্রমণ কমানো। এজন্য প্রতিটি দেশকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে একে নিয়ন্ত্রণে আনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া এটি বেশি চিকিৎসা প্রতিরোধী বলেও প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
ভারতে ব্যাপক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশের পাশাপাশি এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি সংক্রমণকে জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছে হু।
গত ৮ মে ভারতে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৪১৮৭ জনের। তার পর কয়েক দিন মৃত্যু কিছুটা কমে। কিন্তু দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৪২০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও দৈনিক সংক্রমণ পর পর দু’দিন সাড়ে ৩ লক্ষের নীচে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪২১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৯৩৮ জন। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ১৯৭ জনের।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কি ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। তাদের মতে, সংক্রমণের মাত্রা যদি ভারতের অর্ধেক হয়, তাহলেও ভেঙে পড়বে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমাদের হাসপাতালের যে সক্ষমতা রয়েছে তাতে রোগী সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভারত থেকে আসা ৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে বাংলাদেশে দুইজনের শরীরে নিশ্চিত এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। আরও চারজনের শরীরে এই ভ্যারিয়েন্টের খুব কাছাকাছি একটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়াকে অনেকটা অবধারিত বলেই মনে করেন।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ধীরে ধীরে এটা ছড়াবেই। একে বন্ধ করে রাখা যাবে না। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে ঢাকায় ঢুকেছিল। কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এভাবে আসবে না। এটি আসবে স্থলবন্দর দিয়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়াতে ছড়াতে ঢাকায় ঢুকবে। এর স্প্রেডিং ধরণ ভিন্ন রকম হবে। প্রথমে ঢাকার বাইরে ছড়াবে বলে এনিয়ে আশঙ্কাও থাকবে বেশি। কারণ সেসব জায়গায় চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো না। ফলে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্তে অনেকগুলো স্থলবন্দর। এই বন্দর দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক আসছে। আসছেন ট্রকের চালক এবং অন্য সহযোগীরা। তাদের কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না। অথচ তারা এখানেই থাকছেন, এদেশের মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়ী লেনদেন করছেন, ঘুরছেন। তাদের মাধ্যমে এ ভ্যারিয়েন্ট দেশে ঢোকার আশঙ্কা সবসময়ই ছিল।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হলেও আমাদের আশঙ্কা ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট কয়েকমাস আগেই চলে এসেছে। বাংলাদেশের তিনদিকেই ভারত। সবসময় স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ যাতায়াত করছে। কিছুই থেমে ছিল না। ফলে ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে না ঢোকার কোন কারণ নেই।
সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। আবু জামিল ফয়সাল জানান, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভায় গতসপ্তাহে তারা সীমান্ত এলাকাতে নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং কোয়ারেন্টিন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনের মতে ভারতে নির্বাচনী জনসভা, কুম্ভমেলা, কৃষক বিক্ষোভের কারণে সংক্রমণ অনেক বেড়েছে আর নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে ভারতের ভ্যারিয়েন্টের দ্বারা আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো। সেই সঙ্গে এ থেকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবার আশঙ্কাও থাকবে।
রোগীদের শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশনের কোনও বিকল্প নেই বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদ ও পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, যতক্ষণ না টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে রোগীদের শনাক্ত করে যথাযথ আইসোলেশন করা না যাবে, তাদের সংর্স্পশে আসাদের কোয়ারেন্টিন না করা যাবে, ততক্ষণ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রন হবে না। একই কথা জানান ডা.মুশতাক হোসেনও। সূত্র : আনন্দবাজার, জাগোনিউজ, বাংলাট্রিবিউন।