জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রার তারতম্যকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা বিপর্যয়ে লিচু উৎপাদন
মতিনুজ্জামান মিটু : হিসাবে গড়মিল থাকলেও কৃষিবিদ এবং চাষিদের মতে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার লিচুর ফলন কম হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল আওয়াল ও এডিডি কৃষিবিদ মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, এই জেলায় এবার ফলন ৫০ ভাগ কম হবে। শীত থাকতে হঠাৎ গরম পড়ে আবার একনাগাড়ে ১২০ ঘণ্টা ১২ ডিগ্রি বা তার কম ঠা-ার কারণে গাছে ঠিকমত ফুল আসেনি। তাই ফলনও কম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপমাত্রার উঠানামায় এমনটি হতে পারে। মোজাফ্ফরপুরিসহ দেশি জাতের ফলন কিছুটা ভাল হলেও বিপর্যয়ের মুখ পড়েছে বোম্বাইসহ অন্যান্য জাতের লিচু।
ডিএই নাটোরের ডিডি কৃষিবিদ সুব্রত কুমার সরকার বলেন, এবার লিচুর উৎপাদন কমই হবে। রুক্ষ আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এই অবস্থার মুখে পড়েছে লিচুর আবাদ।
পাবনার ডিডি কৃষিবিদ মো. আব্দুল কাদের বলেন, তাপমাত্রার উঠানামা ফলন কমের কারণ। জলবায়ু পরিবর্তন এ অবস্থার জন্য দায়ী। অত্যাধিক তাপমাত্রায় লিচু ফেটে যায় এবং ঝরে পড়ে। এই অবস্থায় ১০ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম বোরন মিশিয়ে স্প্রে করলে ফাটা রোধ ও ১০ লিটার পানিতে ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে স্প্রে করলে লিচু ঝরা বন্ধ হয়।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লিচু চাষি কেতাব মন্ডল বলেন, এ যাবতকালের মধ্যে এবারের লিচুর উৎপাদন মহাবিপর্যয়ে পড়েছে। বাগানের পর বাগানের গাছে এবার ফুল আসেনি। তাই গতবারের চেয়ে শতকরা ৯০ ভাগ লিচুর উৎপাদন কম হবে।
ঈশ্বরদী’র ৬০ বিঘা জমির লিচু বাগানের এই চাষি বলেন, পরিস্থিতি যা তাতে এবার শতকরা ১০ ভাগ লিচুও পাওয়া যাবে না। এতে লিচু উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল দেশের অন্তত ১০ হাজার চাষি ক্ষতির মুখে পড়বেন। এই একমাত্র ফসল লিচুর ওপর ভর করেই তাদের সারা বছরের জীবন জীবিকা চলে। সরকারের প্রণোদনা ও সহযোগিতা রেডিও, টিভি এবং সংবাদপত্রের পাতাতেই আছে বাস্তবে নেই।
যদি থাকতো তবে তাদের একজন হিসেবে আমিও পেতাম। ক্রমাগত লোকসানের এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২/১ বছরের মধ্যেই অনেকে লিচুর বাগান ভেঙ্গে দেবেন।
প্রকৃতি নির্ভর লিচু আবাদ অনেকটাই লটারীর মতো। ভাগ্য ভালো হলে এক একর বাগানের লিচু বেচে ৩ লাখ টাকা লাভ করা যেতে পারে। আর ভাগ্য খারাপ হলে ঐ জমির লিচু বেচে ১০ হাজার টাকা পাওয়াও কষ্টকর হতে পারে।
করোনা, আম্ফান ইত্যাদিতে বছরের পর বছর লিচুর আবাদে নেমে চাষিরা খরচের টাকাও তুলতে পারছেন না। লিচুর বাগান এখন অনেকটাই অলাভজনক হয়ে পড়েছে। বাগান করার প্রথম ৫ থেকে ৭ বছর ধান, পাট ও আখ বাদে সবজিসহ অন্যান্য ফসল সাথী হিসেবে হলেও পরে আর করা যায় না।
নাটোরের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফল চাষি সেলিম রেজা বলেন, ক্রমাগত লোকসানে পড়ে ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের অনেকে তাদের শত শত বিঘা জমির লিচু বাগান ভেঙ্গে দিয়েছে। নগদ টাকায় জমি লিজ নিয়ে, সেচ, সার, পাখী তাড়ানোর নেট ও শ্রমিকসহ অন্যন্য খরচ মিটিয়ে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান এখন অনেকটাই ঝুঁকি নিয়ে করতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, চলতি মৌসুমে দেশের ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৪৩০টি থেকে ৯৫ লাখ ৭ হাজার গাছে ৩১৩০ কোটি ৯৭ লাখ ২০ হাজার থেকে ৩৮০২ কোটি ৮০ লাখ লিচু হওয়ায় কথা ছিলো। প্রতিটি লিচু সর্বনি¤œ দাম ১.৫০ টাকা হারে যার দাম হতে পারতো ৪৬৯৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ৫৭০৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের একটি সূত্র জানান, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে লিচু গাছের আবাদ ও উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৩৯১ হেক্টর জমির গাছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০৯ টন লিচু হয়েছিলো। যা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩১ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমির গাছে হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৮৩০ টন। সম্পাদনা : প্রিয়াংকা