মার্চে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে ১৮ ই-কমার্সে ২৯%
শোভন দত্ত : ২০২০ সালের মার্চে ব্যাংকের ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ ১২৭ জন। চলতি মার্চ শেষে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জনে। করোনা আসার আগে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৯৯ হাজার ১২৯ জন। চলতি মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ১৩৪ জন।
ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮ ও ২১ শতাংশ বেড়েছে। মার্চে ফেব্রুয়ারির তুলনায় ই-কমার্স ট্রানজেকশন বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ এবং পস মেশিনে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
করোনা মহামারিতে কেনাকাটায় কার্ডের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। করোনা আসার আগে যে পরিমাণ লেনদেন হতো, এখন তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি লেনদেন হচ্ছে কার্ডে।
করোনা আসার আগে ২০২০ সালের মার্চে ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রি-পেইড কার্ডে মাসে লেনদেন হতো ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে সেটি বেড়ে হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ডেবিট কার্ডে লেনদেন ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, আর ক্রেডিট কার্ডে পৌনে ২ হাজার কোটি টাকা।
সংখ্যার ক্ষেত্রেও ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ কম। করোনায় ৮ শতাংশের মতো বাড়লেও তা ২০ লাখের নিচে। তবে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ডেবিট কার্ড। শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশের বেশি বা ৩১ লাখ কার্ড বেড়েছে করোনাকালে।
এখন কার্ডে যে লেনদেন হচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই হচ্ছে দেশে। করোনা আসার আগে কার্ডের ব্যয়ের একটি বড় অংশ হতো দেশের বাইরে। তবে করোনায় বিদেশে ভ্রমণ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনও বেশ কমে গেছে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই গ্রাহকদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগের চেয়ে ডিজিটাল লেনদেনে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘করোনার সময়ে গ্রাহকদের নতুন নতুন সেবা দেয়া হয়েছে, যাতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ে। অনলাইন সেবাও বেড়েছে। মানুষ ঘরে বসেই সব ধরনের সুবিধা নিতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে করোনায় ডিজিটাল লেনদেনে গতি বেড়েছে। যার সার্বিক প্রভাব কার্ডের ব্যবহার ও লেনদেনে পড়েছে।’
দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে কার্ড সেবায় শীর্ষে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘করোনার ভয়ে এখনও অনেকে শাখায় গিয়ে সেবা নিতে চাইছেন না। ফলে বিকল্প সেবা মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে। আগের চেয়ে কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। তবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ, আবার বিদেশিরাও আসছেন কম। এ জন্য কার্ডে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন কমেছে। বিমান যোগাযোগ পুরোদমে চালু হলে বিদেশি লেনদেন স্বাভাবিক হবে।’ বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতেন না। এখন অনেকে কার্ডে ঝুঁকছেন।
করোনার সময়ে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের উৎসাহিত করেছে ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ভিসা কার্ড এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও জমা, রেমিটেন্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ ও বেতন-ভাতা প্রদান সবই সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনা শনাক্তের মাস মার্চে ব্যাংকের ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ ১২৭ জন। চলতি মার্চ শেষে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জনে। করোনার এক বছরে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৩১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ জন।
কার্ড ব্যবহারকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনও বেড়েছে। গত বছরের মার্চে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ১৫ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। চলতি মার্চে সেটা বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।
২০২০ সালে মার্চের পর এপ্রিলে ডেবিট কার্ড ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ। মে মাসে তা ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখের মধ্যে। জুনে কার্ড বেড়ে ১ কোটি ৯৭ লাখে এবং জুলাইয়ে ১ কোটি ৯৯ লাখে উন্নীত হয়। সেপ্টেম্বরে সেটা দুই কোটির ঘর অতিক্রম করে। বর্তমানে সেটা দুই কোটি ২৪ লাখের বেশি।
সে সময় ডেবিট কার্ডে আগে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। তা করোনার কারণে এপ্রিলে কমে হয় ৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এরপরে মে মাসে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, জুনে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং জুলাইয়ে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
জুলাইয়ের পর লকডাউন অনেকটা শিথিল হয়। ফলে আগস্টে ডেবিট কার্ডে লেনদেন কমে যায়। ওই মাসে লেনদেন হয় ১৩ হাজার ২০২ কোটি টাকা। কিন্তু এরপরে আবার টানা লেনদেন বাড়তে থাকে। বর্তমানে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ২২ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে।
২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৯৯ হাজার ১২৯ জন, যা চলতি মার্চে বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ১৩৪ জন। ফলে এক বছরে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার ৫ জন।
গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এ বছর মার্চে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
তবে গত বছর লকডাউনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকরীদের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু সুবিধা দেয়া হলেও এ বছর সেটা দেয়া হয়নি। ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের আগে যখন ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথমবারের মতো লকডাউন দেয়া হয়, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডধারীদের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ১২ এপ্রিলের এরপরে সেটা আর কার্যকর হয়নি।
ক্রেডিট কার্ডের বিল সময়মতো দিতে না পারলে জরিমানার পাশাপাশি অনেক বেশি হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকে সুদহার ৯ শতাংশ হলেও কার্ডের সুদ ২০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।
২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব ঋণে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মানে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ হওয়ার কথা ১৪ শতাংশ। তবে এই নির্দেশনাও অমান্য করে অনেক ব্যাংকই বিভিন্নভাবে এর চেয়ে বেশি টাকা আদায় করত।
ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কোনো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে ২০ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না বলে নতুন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ওই বছর ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।
এক বছরে প্রিপেইড কার্ড ব্যবহারকারী বেড়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ জন। মার্চ পর্যন্ত দেশে প্রি-পেইড কার্ডের গ্রাহক ৮ লাখ ১১ হাজার ৭৫৭ জন। গত বছরের মার্চে যা ছিল ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯১ জন। এ সময়ে এসব কার্ডে লেনদেন হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। সূত্র : টিবিএস বাংলা অনলাইন, নিউজবাংলা২৪, বাংলাট্রিবিউন। সম্পাদনা : রেজা