গাজা পুনর্গঠনে মার্কিন জোটের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, সহায়তার অর্থ ছুঁতে চায় না হামাস
ইমরুল শাহেদ : ১১ দিনের সংঘাতে গাজা উপত্যকা অর্থের মানদ-ে কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনও গাজা কর্তৃপক্ষ নিরুপণ করতে না পারলেও তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, শুধু শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ ও কৃষিখাতে ৮৯ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এ হিসাবে নেই বাসভবন, রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য স্থাপনা। তবে ইতিমধ্যে গাজা পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং মিসরের কাছ থেকে ১৪৪.৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা আশ্বাস পাওয়া গেছে। অর্থ সহায়তা করা হবে জাতিসংঘের তহবিল থেকেও। কিন্তু এই আশ্বাসের কতটুকু পাওয়া যাবে তা নিয়ে একটা সন্দেহ রয়ে গেছে।
২০১৪ সালে গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে গাজার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তখনও পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশও গাজা পুনর্গঠনে অর্থ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত দেশগুলো থেকে অর্ধেক সহায়তাও পাওয়া যায়নি। তারা অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছে গাজার শাসক হামাস হলো ইরানের মিত্র।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সংঘাত বিরতির পর দুই দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে আসেন। এসময় তিনি ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, মিসর ও জর্ডান সফর করেন। নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। এরপর তিনি গাজা পুনর্গঠনে মার্কিন সহায়তার কথা ঘোষণা করার পাশাপাশি শর্তও আরোপ করেন। সহায়তার অর্থ কিছুতেই গাজার শাসক হামাসের হাতে যেতে পারবে না।
কিন্তু হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার মার্কিন সহায়তা প্রদানের মধ্যে একটা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির আভাস পাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, গাজা পুনর্গঠনের জন্য যে অর্থ আসবে তারা সেটার দিকে তাকাবেনও না। তবে তারা এই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা চান এবং সুসম বন্টনের কথাও তিনি বলেছেন। তবে ইসরায়েলের কাছ থেকে কোনো সহায়তা নেওয়া যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। গাজা পুনর্গঠন বা মানবিক সহায়তা থেকে তাদের অর্থের প্রয়োজনও নেই।
ইরানের নেতৃত্বে বিভিন্ন উৎস থেকেই তাদের কাছে সামরিক সহায়তা আসছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকা- চালিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আমাদের কাছে আসছে।’ কিন্তু তিনি অভিযোগ করেন, হামাসকে এড়িয়ে গিয়ে অন্য একটি গ্রুপকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ১১ দিনের সংঘাতে হামাসের সঙ্গে এবার আর সম্মুখ সমরে এগিয়ে আসেনি ইসরায়েল। তারা শুধু আকাশ পথেই গাজায় ধ্বংস তা-ব চালিয়েছে। ইসরায়েলের যখনই ইচ্ছা হচ্ছে তখনই তারা নানা অজুহাতে গাজার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য হলো হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা। গাজা ধ্বংস করবে, পুনর্গঠনের জন্য আবার অর্থও দেবে। কিন্তু তারা যে কৌশলেই এগিয়ে যান না কেনÑ হামাস মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। আগে বলা হতো শুধু ইসরায়েলের কারণে গাজা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন শুধু ইসরায়েল নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যই গাজাকে এক অর্থে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এর কারণ হলো ইরান। গাজার শাসকদের সুসম্পর্ক রয়েছে ইরানের সঙ্গে। মার্কিন প্রভাবিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইরানকে ভালো চোখে দেখে না। ইতিমধ্যে ইসরায়েলও কিছু কিছু দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিধর দেশে পরিণত হচ্ছে ইরান, সেহেতু দেশটি ইসরায়েলের জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে যে, ইরানকে কিভাবে দাবানো যায়।
ইরানের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া হামাসও ইসরায়েলের জন্য নিরাপদ নয়। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৌশলে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হয়েছে। ইরানি সংযোগের কারণে লেবাননের হিজবুল্লারাও ইসরায়েলের জন্য নিরাপদ নয়। এজন্য তারাও সন্ত্রাসী। ইরান-হামাস-হিজবুল্লাদের মিত্রতা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইয়েমেনের হুথিরাও।
সৌদি জোট অনেক চেষ্টা করেও হুথিদের নমনীয় করতে পারেনি। হুথিরা নিজেরাই ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন তৈরি করছে। একইভাবে হামাসও নিজেদের মতো করে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। হাতে বানানো এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আয়রন ডোমকেও নাকাল করে তুলেছে। সংঘাত বিরতি না ঘটলে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই হয়তো ইসরায়েল ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ করে বলেছেন, ‘আমরা আস্থাশীল যে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত-বিরতির যে চুক্তি হয়েছে সেটা বলবৎ থাকবে। তবে এটাকে চূড়ান্ত বলা যাবে না। বলা যায়, উক্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এটা হলো প্রথম পদক্ষেপ।’ এসব কথার মাধ্যমে ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চোখে সন্ত্রাসী হামাসকে কার্যত মেনে নেওয়া হলো। সম্পাদনা : রেজা