৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করহার না বাড়লেও করজাল বাড়ানোর পরিকল্পনা
সোহেল রহমান : চলমান করোনা পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে করহার না বাড়িয়ে ও নতুন করারোপ না করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত এ বাজেট পেশ করেন। একই সঙ্গে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং অর্থবিল ২০২১ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন তিনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে করদাতাদের ওপর নতুন বাড়তি চাপ প্রয়োগ করা না হলেও বাজেট প্রস্তাবে চলমান কর ব্যবস্থার সংস্কার সম্পন্ন করা, কর ফাঁকি রোধ করে করজাল বাড়ানো এবং কর-জিডিপি অনুপাত যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয়ে পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের এ আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বাড়ছে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে জিডিপি’র মোট আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে জিডিপি’র ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা (জিডিপি’র ৬ শতাংশ) ধরা হয়েছিল। সে হিসাবে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি বাড়ছে ২৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি পূরণে আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকেই প্রায় সমপরিমাণ ঋণ নেয়া হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য উৎস থেকে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ২০ হাজার ৩ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার ৩ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাজেট ঘাটতির অবশিষ্ট ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা নেয়া হবে বৈদেশিক উৎস থেকে। এর মধ্যে নীট ঋণের পরিমাণ ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা এবং অনুদান প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা।অন্যদিকে নতুন অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
রাজস্ব ও অন্যান্য আদায়
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআর আওতাধীন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবারও তা-ই রাখা হয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছর ও চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের গতিধারা পর্যালোচনা করে লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় ১৬ হাজার কোটি টাকা এবং কর-বহির্ভূত আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথমবারের মত রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই ২০২০-এপ্রিল ২০২১) গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে রাজস্ব আদায় বাড়লেও বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়
প্রতিবারের মত এবারও বাজেটে পরিচালনা ও অন্যান্য খাতে (অনুন্নয়ন) ব্যয় বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৬২ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ ৬ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা) এবং ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে ৮৮ হাজার ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন এডিপি’র আকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি’র তুলনায় ৯.৮৪ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে মূল এডিপি’র আকার ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও