আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ১৫টি আইন প্রণয়ন করা হবে পাচার কীভাবে হয় জানি, কারা করে জানি না : অর্থমন্ত্রী
সোহেল রহমান : সোমবার জাতীয় সংসদে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় দেশ থেকে অর্থ পাচার এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা। একই সঙ্গে এসব কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা না-নেয়া এবং তাদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের এসব অভিযোগের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমি অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। দেশের মানুষের কষ্টে অর্জিত টাকা বিদেশে চলে যাবে, এতে আপনাদের যেমন লাগে, আমারও লাগে। আমরা সবাই এগুলো বন্ধ করতে চাই।
অর্থ পাচার সংক্রান্ত তথ্য কারও কাছে থাকলে তা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমি জানি কীভাবে এগুলো হয়, কারা করে জানি না। কারা টাকা নিয়ে যায়, সেই লিস্ট আমার কাছে নেই। নামগুলো আমাদের দেন। কাজটি করা আমাদের জন্য সহজ হবে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য এগুলো হয়।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, তবে আগে যেমন ঢালাওভাবে চলে যেত, এখন তেমন নেই। আগে সিমেন্টের নাম করে বালি আসত। একটার নাম করে আরেকটা আসত। আন্ডার-ইনভয়েসিং ও ওভার-ইনভয়েসিং আগের মতো হয় না। একদম বন্ধ হয়ে গেছে বলব না। পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই না। এছাড়া এখন অনেকেই জেলে আছে। বিচার হচ্ছে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ১৫টি আইন প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সংস্কারমুখী কাজ করব। নতুন নতুন আইন করব। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দায় নিয়ে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দেব। কোনো টলারেন্স নেই এখানে। টাকা এখন দেশে আসে।
প্রসঙ্গত গত বছর ১৮ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়ার কথা জানান। প্রাথমিকভাবে অর্থপাচারে জড়িত যাদের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি বলে জানান তিনি। এছাড়া রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী থাকার কথাও জানান তিনি। তবে তিনি কারও নাম প্রকাশ করেননি। সে বক্তব্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাঙালি অধ্যুষিত কানাডার ‘বেগমপাড়া’র প্রসঙ্গ উঠে আসে। সেসব প্রতিবেদন নজরে আসার পর গত ২২ নভেম্বর হাই কোর্ট অর্থ পাচারকারী, দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি নাÑ তা জানতে চায়। তবে দুদকের দেয়া জবাবে আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলে জানা যায়।
সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনাকালে বিএনপি’র সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিবারের হাতে ব্যাংক তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনগণের টাকার হরিলুট হচ্ছে। সংসদে ঋণ খেলাপির তালিকা দেয়া হল ৩০০ জন। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হল। বিদেশে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে চলে যাচ্ছে। ওভার ও আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যাচ্ছে। এর বাইরে হুন্ডির পরিমাণ ধরলে কে জানে কত টাকা বিদেশে গেছে।
তিনি আরও বলেন, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, শেয়ারবাজার শুয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে ও ২০০৯ সালে শুয়ে পড়ল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বললেন, তিনি শেয়ারবাজার বোঝেন না। শেয়ার বাজার ফটকা বাজার। সেই অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট কথা বলতেন, দলের বিপক্ষে গেলেও বলতেন।
বিএনপি’র আরেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, বাজেটের অংকের হিসাব মেলাতে পারছি না। ঘাটতি মেটাতে কোথা থেকে টাকা আনবে। করোনাকালীন সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে করোনা নিয়ন্ত্রণে। না হলে প্রবাস আয়, গার্মেন্টস খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রবৃদ্ধির জন্য লাফাচ্ছি। সূচের ফুঁটো দিলে বেলুনের মত চুপসে যাবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ না করলে ভয়ানক ধস নামবে।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আর্থিক খাতে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্ব সঠিক, কিন্তু কর্তৃত্ব দুর্বল। ব্যাংকে কর্তৃত্ব নেই। কর্তৃত্ব না থাকলে অবাধে এসব হবে। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংকের টাকা নিচ্ছে। টাকা নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ পাঠাচ্ছে। দুদকের একটি অফিস কানাডায়, মালয়েশিয়ায়, অস্ট্রেলিয়ায় করুন। তাহলে দেখা যাবে কে কত টাকা নিয়েছে। পিকে হালদার এত টাকা নিল। নয় মিনিটের জন্য পিকে হালদারকে ধরতে পারেনি। তাহলে নয় ঘণ্টা আগে ধরতে পারলেন না কেনÑ এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্যাতিত এতিমদের মত। দেখার কেউ নেই। লুটপাট হচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে। কিছুই হয় না। শাস্তি হয় না।
পুঁজিবাজার নিয়ে সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজার সম্পর্কে তথ্য রাখেন না, হয়তো সেজন্য বলছেন। যদি ডেটা দেখি, যখন ক্ষমতায় আসি তখন পুঁজিবাজারে লেনদেন ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ছিল। এখন তা পাঁচ গুণ বেড়েছে। গড় লেনদেন ছিল দৈনিক ২৮ কোটি টাকা, যা এখন ৩০ গুণ বেড়েছে। তাহলে ধসে গেল কেমন করে।