নেতানিয়াহুর রাজত্ব শেষে ইসরায়েল শক্তিশালী হলেও বিভক্ত
রাশিদ রিয়াজ : টানা ১২ বছর ইসরায়েলের ক্ষমতায় ছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার রাজত্ব আপাতত শেষ। ইসরায়েল আগের চেয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী। কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও নেতানিয়াহু রেখে গেলেন স্থবির শান্তি প্রক্রিয়া। নেতানিয়াহু পরিচিত ছিলেন ‘কিং বিবি’ হিসেবে, এক মহান ক্ষমতার যাদুকর ও ইসরায়েলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ও দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজত্ব করেছেন দাপটের সঙ্গে।
১৩ জুন ইসরায়েলের সংসদে ভোটাভুটিতে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে অর্থাৎ ৬০-৫৯ ভোটের ব্যবধানে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন নাফতালি বেনেট। নেতানিয়াহুর সমর্থকদের দৃষ্টিতে তিনি হলেন আধুনিক সময়ের ইসরায়েলের অক্লান্ত সুরক্ষাকারী যিনি বিশ্ব মঞ্চে বহিরাগত প্রভাব থেকে ক্ষুদ্র ইহুদি জাতিকে একটি অর্থনৈতিক ‘পাওয়ার হাউসে’ পরিণত করতে সহায়তা করেছিলেন। তার সমালোচকরা বলেন নেতানিয়াহু বিভক্ত সৃষ্টি করে ইসরায়েলের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রকে নাজুক করেছেন আর এর ফলে সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।
প্রশ্নহীনভাবে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের উপর একটি অবিস্মরণীয় চিহ্ন রেখে গেছেন, তার পথ পরিবর্তন করে ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। যদিও তিনি আপাতত সর্বোচ্চ পদ ছাড়ছেন, তবে ক্ষমতার বলয়ে তার প্রভাব খুব বেশি দূরে নয়। ব্রুকিং ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর মিডিল ইস্ট পলিসির পরিচালক নাতান স্যাক্স নেতানিয়াহু সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে বলেন ১২ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পর এখন নেতানিয়াহুর কিছুটা দোষ প্রাপ্য হয়ে পড়েছে।
বছরের পর বছর ইসরায়েলের রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব রাখলেও হালে ইসরায়েলি নাগরিকদের সমর্থন ব্যাপকভাবেই হারান নেতানিয়াহু। ১৯৯৬ সালে শিমোন পেরেসকে সরাসরি নির্বাচনে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসীন হলেও তার দল এখন ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। লিকুইদ পার্টির জন্যে তিনি কতটা ভোট টানতে পারছেন তারচেয়ে বরং বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তিনি কোনো জোটের আস্থা অর্জন করতে পারেননি।
‘বিবি: দি টারবুলেন্ট লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’ বইটির লেখক ও দি ইকোনোমিস্ট এবং হারেৎজ’এর সাংবাদিক অ্যানশেল ফেফার বলেন আল্ট্রা-অর্থডক্স দলগুলো ও ডানপন্থী দলগুলোকে লিকুদ পার্টির ছায়াতলে এনে নেতানিয়াহু এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, ইসরায়েলের ক্ষমতার বিকল্প আর কেউ ছিলেন না। লিকুদ পার্টির মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ভোটারদের আস্থা ছিল প্রবল। তাই ঘুরে ফিরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নেতানিয়াহুর অবস্থান ছিল অনড়। সমালোচকরা আরো বলেন নেতানিয়াহুর প্রবল উপস্থিতি সত্তে¦ও এক পর্যায়ে বাম এবং ডান, ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি এবং ইহুদি ও আরবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই ফাটল মেরামতে নেতানিয়াহু ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
২০১৮ সালে একটি বিতর্কিত আইনের পক্ষে অবস্থান নেন যা আরবি ভাষাকে নিচু অবস্থানে নিয়ে যায় এবং সংখ্যালঘু অধিকারের কথা ওই আইনে উল্লেখ ছিল না। ইহুদিদের ইসরায়েলে ‘জাতীয় স্ব-সিদ্ধান্তের একচেটিয়া অধিকার আছে’ এমন ধারা ছিল আইনে। আইনটির বেশিরভাগ অংশ প্রতীকী হলেও এটিকে ইসরায়েলি গণতন্ত্রের ‘কফিনে পেরেক’ বলে সমালোচনা ওঠে। এর পরের বছর সরকার পরিচালনায় নেতানিয়াহু ব্যর্থতার পরিচয় দেন। একের পর এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন করা যায়নি। এর পাশাপাশি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিচারবিভাগে তার হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। বিচার বিভাগের সমালোচনা করায় নেতানিয়াহুর ওপর আস্থা আরো হ্রাস পায়।
গত দুই বছর ধরে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ভাগ্যকে নিজের ব্যক্তিগত ভাগ্যে পরিণত করেছিলেন এবং এতে তা তাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইসরায়েলে কোভিড মোকাবেলা বেশ সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন নেতানিয়াহু। মহামারী পরিস্থিতি থেকে ইসরায়েলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারায় সারা বিশ্বে নেতানিয়াহু নন্দিত হলেও চলতি বছর নির্বাচনের পরে নেতানিয়াহু এবং তার মিত্রদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন। গাজায় হামলা এবং এই প্রথমবারের মত ইসরায়েলি সীমানা অতিক্রম করে হামাসের সহ¯্রাধিক রকেট এসে আঘাত হানলে ইসরায়েলি নাগরিকদের মনে ব্যাপকভাবে নিরাপত্তাহীনতার ভীতি তৈরি হয়। এবছরের প্রথম ৫ মাসে ইসরায়েলের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পায় ৬৬ শতাংশে। ইসরায়েলে বিদেশি বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ গাজার সঙ্গে যুদ্ধের পর এ ধরনের প্রশ্ন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে যেসব আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েল স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে সফলতা পায় গাজায় ইসরায়েলি হামলা তাতে নতুন করে স্থবিরতা এনে দেয়। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তোলে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানকে পাত্তা না দেওয়া কিংবা অসলো চুক্তির বিরোধিতা নেতানিয়াহুর ওপর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আস্থাকে কেবলি নিরাশ করে তুলেছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে জেরুজালেমকে একতরফাভাবে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি ও মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তরের ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংকট নিরসন সুদূর পরাহত করে তোলে। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেদ কুশনার যিনি নেতানিয়াহুর প্রবল সমর্থন পান কিন্তু তাদের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংকট নিরসনে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ট্রাম্পের ‘ডিল অব দি সেঞ্চুরি’কে ফিলিস্তিনিরা ‘সøাপ অব দি সেঞ্চুরি’ হিসেবে অভিহিত করে। একই সঙ্গে ইরানের জেনারেল কাসেম সোলায়মানি ও বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরেজাদেহ হত্যার পর মোসাদের এই দুই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার ঘোষণা পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন করে তোলে।
নাতান স্যাক্স বলেন নেতানিয়াহু দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের রাজনীতি ও তার দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন যার আদতে কোনো সমাধান নেই। বরং তা দিনের পর দিন আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে বলে ইসরায়েলের অভিপ্রায় ফিলিস্তিনিদের নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়ন এবং তাদের বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের সাথে মিলিত হয়েছে। যখন এসব উপাদান একসাথে ঘটে তখন তা বর্ণবাদী অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ প্রতিবেদনকে তার দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অবস্থান বিরোধী হিসেবে উল্লেখ করেন।
সাংবাদিক অ্যানশেল ফেফার বলেন সুদান, আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে ইসরায়েলকে কোনো ছাড় দিতে হয়নি এবং এক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্টা ছিল অপরিসীম। নেতানিয়াহুর সমর্থকরা এখনো মনে করেন ইসরায়েলের জনসংখ্যা এক কোটিরও কম কিন্তু বিশ^মানচিত্রে দেশটির অবস্থান অনেক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হিসেবে ভূমিকা রাখছে এবং তা নেতানিয়াহুর কারণেই হয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নেতানিয়াহুকে ‘স্মার্ট, বিচক্ষণ, কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও প্রতিভা সম্পন্ন নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন তার সাবলীল ইংরেজি ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ওপর গভীর জ্ঞান তাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সিএনএন