এসডিজি বাস্তবায়নে চার বছরে ১১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ
সোহেল রহমান : জাতিসংঘ গৃহীত ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ (এসডিজি) অর্জন ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। ২০১৫ সালে এসডিজি গৃহীত হওয়ার পর সার্বিক স্কোরের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘ-এর ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক’ কর্তৃক গত সোমবার প্রকাশিত ২০২১ সালের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০৯তম। এর আগে ২০১৭ সালের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে ১১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এসডিজি সূচকে এবার বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর হচ্ছে ১০০-এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৫। গত বছর এই স্কোর ছিল ৬৩ দশমিক ২৬ এবং এর আগের বছর ছিল ৬৩ দশমিক ০২। যে বছর এসডিজি গৃহীত হয়, সে বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৯ দশমিক ০১। আর ভিত্তিবছর ২০০০ সালে স্কোর ছিল ৫৩ দশমিক ৪৯।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এবারের সূচকে অবস্থা সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভূটান। দেশটির অবস্থান হচ্ছে ৭৫তম ও সার্বিক স্কোর হচ্ছে ৬৯ দশমিক ৯৮। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে ভারত (অবস্থান ১২০তম, স্কোর ৬০.০৭), পাকিস্তান (অবস্থান ১২৯তম ও স্কোর ৫৭.৭২) ও আফগানিস্তান (অবস্থান ১৩৭তম ও স্কোর ৫৩.৯৩)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের পর থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোই এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। এবারের তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ফিনল্যান্ড-এর স্কোর হচ্ছে ৮৫.৯ এবং সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের স্কোর ৩৮.২৭। বিগত বছরগুলোতে স্কোরের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে জেনেজুয়েলা, টুভালু ও ব্রাজিলের।
করেনা মহামারীর কারণে বৈশ্বিকভাবে এসডিজি বাস্তবায়নে ধীরগতির কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারী কেবল স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি, টেকসই উন্নয়নেও সঙ্কট তৈরি করেছে। মহামারীর কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা রয়েছে। চলতি বছর ৪৮টি দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এর মধ্যে ২৮টি দেশই তাদের বার্ষিক বাজেটে এসডিজির প্রসঙ্গ রাখেনি। এসডিজি’র যে ছয়টি মূল লক্ষ্য, সেগুলোতে জোর দিয়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের আর্থিক পরিকল্পনা সাজানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন প্রকাশকালে ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক’-এর প্রেসিডেন্ট জেফ্রি ডি সাকস বলেন, এসডিজির লক্ষ্যগুলোতে উন্নতির ধারায় ফেরার জন্য উন্নয়নশীন দেশগুলোকে আর্থিক খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। সেজন্য কর কাঠামোর সংস্কারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো থেকে অর্থায়ন বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে।
পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) স্থির করে। এর আওতায় ১৭টি বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এগুলো বাস্তবায়নে ‘২০৩০ এজেন্ডা’ শীর্ষক কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে এসডিজি-১২ (পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন ধরন নিশ্চিত করা) এবং এসডিজি-১৩ (জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ)-এর লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পূরণ করে ফেলেছে। এ দুই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ‘সবুজ’ রঙের ক্যাটাগরিতে রয়েছে।
এসডিজি-৪ (সকলের জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা) সূচকে বাংলাদেশ ‘হলুদ’ রঙের ক্যাটাগরিতে রয়েছে। অর্থাৎ এ লক্ষ্য অর্জনে আরও অনেক কাজ করতে হবে।
অবশিষ্ট সূচকগুলোর মধ্যে ৬টি সূচকে ‘কমলা’ ও ৮টি সূচকে ‘লাল’ রঙের ক্যাটাগরিতে রয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ এসব সূচকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ-কে বড় ও বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
‘কমলা’ রঙের ক্যাটাগরিতে থাকা সূচকগুলো হচ্ছেÑ এসডিজি-১ (সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান); এসডিজি-২ (ক্ষুধামুক্ত ও খাদ্য নিরাপত্তা); এসডিজি-৫ (জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন); এসডিজি-৭ (সাশ্রয়ী ও টেকসই জ্বালানি সহজলভ্য করা); এসডিজি-৮ (শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি, স্থিতিশীল ও অন্তর্ভূক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন) ও এসডিজি-১০ (অন্ত: ও আন্ত:দেশীয় অসমতা কমিয়ে আনা)।
‘লাল’ রঙের ক্যাটাগরিতে থাকা সূচকগুলো হচ্ছেÑ এসডিজি-৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ); এসডিজি-৬ (নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন); এসডিজি-৯ (অভিঘাত সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়ন); এসডিজি-১১ (নিরাপদ টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা); এসডিজি-১৪ (সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার); এসডিজি-১৫ (স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, ভূমির অবক্ষয় রোধ ও জীববৈচিত্র হ্রাস প্রতিরোধ); এসডিজি-১৬ (অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলন, ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা) এবং এসডিজি-১৭ (বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবিতকরণ)। এই ক্যাটাগরিতে থাকা সূচকগুলোর মধ্যে এসডিজি-১৫ (স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, ভূমির অবক্ষয় রোধ ও জীববৈচিত্র হ্রাস প্রতিরোধ) সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।