বরাদ্দ বিতরণের ক্ষেত্রে নতুন দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেঅগ্রাধিকার দিতে হবে : সিপিডি
সোহেল রহমান : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা নিছক সংখ্যার খেলা বলে মন্তব্য করে এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর জোর সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি)।
সংস্থাটি বলেছে, বরাদ্দ বিতরণের ক্ষেত্রে নতুন দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও আয় কমে যাওয়া পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও আয় কমে যাওয়া পরিবারগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা প্রদানে প্রয়োজনে নগদ সহায়তার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক বাজেট বরাদ্দ বাধা হওয়া উচিৎ নয়।
বৃহস্পতিবার সিপিডি-অক্সফাম-এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘কোভিড কালীন এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কী আছে’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনায় এসব সুপারিশ ও অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। ভার্চুয়াল আলোনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোভিড পরিস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে কোভিড পরিস্থিতিতে সৃষ্ট ‘নতুন দরিদ্রজনগোষ্ঠী’কেও বাজেটে উপেক্ষা করা হয়েছে। পেনশনারদের বিষয়টি বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে জিডিপি’র মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে বেড়েছে ১১ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ভর্তুকি হিসেবে ৬ হাজার ২৭০ কোটি টাকা (৫২.৬%), পেনশনারদের জন্য ৩ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা (৩০.৯%) ও সঞ্চয়পত্রের সুদ সহায়তা খাতে ৯৩ কোটি টাকা (০.৮%) ব্যয় হবে। অর্থাৎ বর্ধিত বরাদ্দের ৮৪ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় হবে উল্লিখিত তিন খাতে। সে হিসাবে প্রকৃত বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা (২.৯%) শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষাবৃত্তি, কাবিখা, টেস্ট রিলিফ ও আশ্রয়ন প্রকল্প সামাজিক নিরাত্তার এসব উপখাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে।
অন্যদিকে করোনার মহামারীর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে ৫ হাজার কোটি টাকার দুটি তহবিলের কথা বাজেটে বলা হলেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কর্মসূচি নেই।
অন্যান্যের মধ্যে করোনার আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ পুনর্গঠন করা, প্রণোদনা প্যাকেজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো, ভর্তুকি সুদে ঋণ সহায়তা আরও বাড়ানো, এনজিও ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বাড়ানো ও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, করোনার কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তারা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পাননি। পরে তাদের অনেকেই কাজ পেয়েছেন। তবে আয় কমেছে। এর পরিমাণ গড়ে ১২ শতাংশ। করোনার কারণে সেবা খাতে চাকরি কমেছে। আর কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬ জেলার ২৬০০ খানার ওপর এই জরিপ চালানো হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সংসদে বাজেট আলোচনা একটি নাটক মঞ্চস্থের মতো। সংসদে বাজেট নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল আলোচনা হয় না। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অভীষ্ট মানুষেরা বাদ পড়ে যাচ্ছে, অন্যরা ঢুকে পড়েছে। আর কোভিডকালে নতুন গরিব বেড়েছে। নতুন গরিব ও পুরোনো গরিবÑ এই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। মানুষ কতটা ঝুঁকিতে আছে, সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়। গরিব মানুষ ও দরিদ্রপ্রবণ এলাকা বিবেচনায় গরিব মানুষের জন্য বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বাজেট নাটক কি না, জানি না। একটি স্টেজ থাকে, সেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই। বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা অর্থহীন। আলোচনা করতে হয় বলেই করি। দশ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলে কী হয়, একটি পয়েন্ট আলোচনা করতেই ১০ মিনিট চলে যায়। প্রান্তিক মানুষের কথা বাজেটে না এলে বাজেট অর্থহীন। তার মতে, বাজেট অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে।
সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সাংসদ আলী আশরাফ মনে করেন, তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। বাজেট আমলানির্ভর হয়ে গেলে তা ভালো লক্ষণ নয়।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, যদি এমন ব্যবস্থা করা হয় যে, করোনার সময় যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো কর্মী ছাঁটাই করবে না, তারা আড়াই শতাংশ কর ছাড় পাবে। আর যারা ১০ শতাংশ নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, তাহলে কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সভাপতির বক্তব্যে সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তিন ধরনের শুভংকরের ফাঁকি আছে। এগুলো হলোÑ বরাদ্দ যা নয় তার চেয়ে বেশি করে বলা; দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ গরিবদের যে অনুপাতে পাওয়ার কথা, সেই অনুপাতে পাচ্ছে না। আর তৃতীয়টি হচ্ছেÑ বরাদ্দ যেটি দেয়া হয় সেটি যাদের পাওয়া উচিত, তারা পায় না। বলা হয়, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তাহলে তাতে গরিবদের হিস্যা কেন বাড়বে নাÑ এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি। সম্পাদনা : রেজা