২০২৫ সালের আগে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নয় বাজেটে বিদ্যুৎখাতে সঞ্চালন-বিতরণের ওপর জোর দেয়া উচিত : সিপিডি
সোহেল রহমান : প্রস্তাবিত বাজেটে বিদুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, বিদ্যুৎ উপাদনে পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো এবং সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’ (সিপিডি)।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের সফলতার প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ খাতের পুনঃপর্যালোচনা ও সংস্কারের পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে সংস্থাটি বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্লিন-এনার্জি ও কম-কার্বন নিঃসরনের বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার থাকলেও বাজেটে তা প্রতিফলিত হয়নি। উপরন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে কয়লাসহ অন্যান্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে নতুন করে বরাদ্দ দেয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
রোববার ‘প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ২০২১-২২-এ বিদ্যুৎ খাত’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এসব অভিমত ব্যক্ত করেছে সিপিডি। সংলাপে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংস্থার গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। যা লোড-শেডিং-এর অন্যতম কারণ। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৬ জুন পর্যন্ত দেশে কোনো লোড-শেডিং হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়েছে, যা বিস্ময়কর।
প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেয়ে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরত্বারোপ করে বলা হয়, নতুন এডিপি-তে বিদ্যুৎ খাতে মোট বরাদ্দের ৬২ শতাংশেরও বেশি রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। অন্যদিকে বিদুৎ সঞ্চালনে ১৯.২৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮.৭২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে উৎপাদন খাতে রাখা ৬২ শতাংশ বরাদ্দ সঞ্চালন ও সরবরাহ খাতে স্থানান্তর করা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও বরাদ্দ কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদন করতে হবে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে মাত্র ৭২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২.৮৪ শতাংশ।
এছাড়া প্রতিবেদনে আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত নতুন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু না করা; সব ধরনের দ্রুত ও ভাড়া-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ না বাড়ানো এবং এগুলোর নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা; কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো বরাদ্দ না দেয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ভাড়া-ভিত্তিক এখনও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে, যেগুলো অবসর নেয়া উচিত ছিল। বিতরণ ব্যর্থতার জন্য অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কতটুকু দায়ী তা শনাক্ত করা দরকার।
বিদ্যুৎ সেল-এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর এবং এ লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে। দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে অপসারণ করা হবে। অন্যদিকে সৌর ও বায়ুশক্তির বাইরেও নবায়নযোগ্য শক্তির সন্ধান করা দরকার যার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম তামিম বলেন, জ্বালানি উৎপাদনের অতিরিক্ত ক্ষমতা কেবল কাগজে উপস্থিত রয়েছে, বাস্তবে নয়। একদিকে কাগজে কলমে বলা হচ্ছে, সরকার কোল পাওয়ারে আর বিনিয়োগ করবে না। কিন্তু অন্যদিকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আবার কোল পাওয়ারেই ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের শতভাগ এলাকায় গ্রীড লাইন নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ৯৫ ভাগ এলাকায় এই লাইন গেলেও চলবে। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হবে। কিন্তু যে এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব কম সেখানে লাইন স্থাপন করে কী লাভ। ঔসব এলাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাতটি বিশ্লেষণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদক সমিতি (বিআইপিপিএ)-এর সভাপতি ইমরান করিম সুপারিশ করেছিলেন যে জ্বালানি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে টগল করার সক্ষমতা থাকা উচিত।
বিজিএমইএ’র পরিচালক আসিফ আশরাফ বিদ্যুতের গুণগত মানের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, এখানে বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু তা গুণগতমান কতখানি Ñতা আমাদের দেখতে হবে। আগে বিদ্যুৎ অনেকক্ষণ ধরে থাকতো না।
কিন্তু এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও এখন প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ থাকে না। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কারণ ৫ মিনিট বা ১০ মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলেও উৎপাদন পুরোদমে শুরু করতে ৩০ মিনিট লেগে যায়। আর এতে পণ্যের গুণতম মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, আবার উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। বেজায় যারা শিল্প স্থাপন করেছে, তাদের ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য গ্যাস সংযোগ দেয়ার সুপারিশ করেন তিনি ।
সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যদি বিনিয়োগ দক্ষতা বাড়ানো যায়, তবে এতে একদিকে যেমন ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্য বিদ্যুৎ কিনতে পারবেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবেন।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিদ্যুতের মান নিশ্চিত করা দরকার। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় শিল্পের উৎপাদন ব্যয় এবং দক্ষতা ব্যাহত হয়। সম্পাদনা : রেজা