পণ্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় ইভ্যালির ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ গ্রাহক
মো. আখতারুজ্জামান : ইভ্যালি শুরুর দিকে চালু করা হয় ভাউচার নামক একটি পদ্ধতি। এতে দেওয়া হতো ৩০০ শতাংশ ও ২০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের অফার নিয়ে আসে। এসব অফারের নামও দেয়া হয় আকর্ষণীয়। সাইক্লোন, ধামাকা, ফূর্তি সহ।
যদিও এখন এসব অফার বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ গ্রাহক তাদের ক্রয়কৃত পণ্য পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে প্রতিদিন পণ্য না পাওয়া গ্রাহকদের জটলা দেখা যায়। অফিসে আসা গ্রাহকদের হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও হাজার হাজার অভিযোগ ইভ্যালির বিরুদ্ধে।
প্রতিষ্ঠটির নানা ধরনের অফার শুরু হতো রাত ১২টার পর থেকে। যদিও এখন এসব অফার বন্ধ করে দিয়েছে। ইভ্যালির টার্গেই ছিলো যুব সমাজ। তারা সব থেকে বেশি অর্থ আয় করেছে মোটরসাইকেলের নানা অফার দিয়ে। তবে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই। অনেকে আছেন, যারা এক বছর আগে মূল্য পরিশোধ করেও এখন পর্যন্ত পণ্য পাননি। আবার অনেককে যে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেছেন সেই পণ্য না দিয়ে নিম্নমানের পণ্য দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির মোট গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ জন। ক্রয়াদেশ বাতিল, ইভ্যালির দেওয়া ক্যাশব্যাক, বিক্রিত গিফটকার্ডের সমন্বয়ে এসব গ্রাহকদের ভার্চুয়াল আইডিতে ৭৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মূল্যে ই-ভ্যালু সংরক্ষিত ছিল।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইভ্যালি চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিয়ে কোনো পণ্য সরবরাহ করেনি। অন্যদিকে তারা যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কেনে, তাদের কাছে ইভ্যালির বকেয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ইভ্যালির চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও পাওনাদারদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব। বাকি প্রায় ৮৪ শতাংশ বা ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে। কোম্পানিটি প্রতি এক টাকা আয়ের জন্য তিন টাকা ৫৭ পয়সা বিক্রয় ব্যয় করেছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ইভ্যালির চলতি দায় ও লোকসান দুটিই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্ট চক্রে বাঁধা পড়েছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ক্রমাগতভাবে সৃষ্ট দায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকে না থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে নানা প্রতারণা ও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তদন্তে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত না দেওয়া, ক্যাশব্যাক হিসাবে টাকা না দিয়ে ই-ব্যালেন্স দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে গত ১২ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিনের কাছে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশ সদর দপ্তরকে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযো গমাধ্যমে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের লোগো, নাম এবং অলঙ্কার হুবহু নকল করে প্রচার ও বিক্রির অভিযোগে ই-কমার্স ওয়েবসাইট ইভ্যালি ডট কমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিডেট। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য হেন কোনো জায়গায় নেই সেখানে বিনিয়োগ করেনি। রাস্তা-ঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড থেকে শুরু করে নানাভাবে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিছেদের পরিচিত করতে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলের স্পন্সর হয়েছিলো ইভ্যালি। এর জন্য প্রতিষ্ঠানটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ২ কোটি টাকা দেয়।