জাতীয় পদক-পুরস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
অর্থনীতির চাহিদা-সরবরাহ তত্তে¡র কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত : পণ্যের মূল্যবান ব্র্যান্ড, অভিজাত ক্লাবের সদস্য পদ ও জাতীয় পদক-পুরস্কার। ২০১১ সালে খড়ঁরং ঠঁরঃঃড়হ ব্র্যান্ডের মহিলাদের হাতব্যাগের বিজ্ঞাপনে হলিউডের বিখ্যাত চিত্রতারকা অ্যাঞ্জেলিনা জলির একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে প্রগতিশীল গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো। ছবিটিতে তাঁকে ওই ব্র্যান্ডের একটি ব্যাগ কাঁধে ক্যামবোডিয়ার পাÐববর্জিত একটি জলাভ‚মিতে একলা নৌকায় বসে থাকতে দেখা যায়। ফ্যাশন জগতে আবেদন সৃষ্টির উদ্দেশে তৈরি ওই বিজ্ঞাপনকে একটি গরিব দেশের দারিদ্র্যকে উপহাস করার সামিল বলে অভিযোগ করা হয়। বিলাতের ঞযব এঁধৎফরহ পত্রিকা একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিলো : ডযধঃ’ং অহমবষরহধ ঔড়ষরব ফড়রহম রহ ধ ংধিসঢ় রিঃয ধ £৭,০০০ নধম? (১৪ জুন ২০১১) অবশ্য, অ্যাঞ্জেলিনা জলির নিজের মতে, ক্যামবোডিয়ার ওই ভ্রমণ ছিলো তাঁর জীবনের একটি বড় অভিজ্ঞতা, যা তাঁর জীবনবোধকে বদলে দিয়েছিলো। এমনকি ওই বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া তাঁর অর্থের অর্ধেক তিনি চ্যারিটিতে দান করেছিলেন বলে শোনা যায়।
মূল্যবান ব্র্যান্ডের পণ্যের চাহিদা : দেখা গেছে কিছু কিছু অতি দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম এতো বেশি রাখা হয় বলেই ওই সব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়, যা অর্থনীতির চাহিদা তত্তে¡র (দাম বাড়লে চাহিদা কমে) ঠিক উল্টো। সুইজারল্যান্ডের চধঃবশ চযরষষরঢ়ঢ়ব ব্র্যান্ডের সব চেয়ে কম দামের হাতঘড়ির দামও সাড়ে বারো হাজার মার্কিন ডলার, কিন্তু সে তুলনায় একশ ডলারের একটি জাপানি ঈরঃরুবহ বা ঈধংরড় ব্র্যান্ডের ঘড়ি তেমন কোন খারাপ সময় দেবে না। সমাজের বিত্তবানদের নিজেদেরকে আলাদা শ্রেণি হিসেবে জাহির করার প্রবণতা থেকেই এ ধরনের অতি দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়। একই কারণেই খড়ঁরং ঠঁরঃঃড়হ ব্র্যান্ডের মহিলাদের একটি হাতব্যাগের দাম প্রায় এক হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে; আর তার থেকেও নামিদামি ঐবৎসবং হাতব্যাগের দাম দশ হাজার থেকে একশ হাজার ডলারের বেশি হতে পারে, যদিও অনেক কম দামের একটি সাধারণ ব্যাগের তুলনায় এদের গুণগত মানে এমন কোনো বেশি পার্থক্য আছে বলা যায় না।
আভিজাত ক্লাবের সদস্য পদের মূল্য নির্ধারণ : দেখা যায় যে কলিকাতার ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ক্লাব ‘ক্যালকাটা ক্লাব’ বা ঢাকার ‘ঢাকা ক্লাব’-এর সদস্য পদ পেতে হলে এককালীন ও নিয়মিত যে ফি দিতে হয় তা ঐসব ক্লাবের সদস্য হিসেবে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি। তবে ক্লাবের পরিচালকরা ইচ্ছা করলে তার থেকে অনেক বেশি ফি নির্ধারণ করলেও সদস্য পদ পেতে আগ্রহী মানুষের অভাব হবে না; অর্থাৎ, বাজার দামের থেকে কম মূল্য তাঁরা ইচ্ছা করেই নির্ধারণ করছেন। কেন?
এ ধরনের ক্লাবে মোটা দাগে দুই শ্রেণির সদস্য থাকেন : [এক] সমাজের নামিদামি প্রভাবশালী ব্যক্তি, যথেষ্ট সচ্ছল হলেও যাঁদের সহায়-সম্পত্তি অফুরন্ত নয়। দুই, খুবই বিত্তশালী হলেও সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে আছেন, যাঁরা সামাজিক কৌলিন্য অর্জন এবং প্রথম শ্রেণির ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা অর্জনের একটা উপায় হিসেবে সদস্য পদ লাভের জন্য অনেক বেশি ব্যয় করতে সক্ষম ও আগ্রহী। কিন্তু অতো বেশি ফি নির্ধারণ করলে প্রথম শ্রেণির সদস্যদের আনুপাতিক সংখ্যা ক্রমে কমে যাবে, যার ফলে ক্লাবটির সদস্য পদের সামাজিক মর্যাদাও কমতে থাকবে। পরিণামে দ্বিতীয় শ্রেণির সদস্যরাও অত বেশি খরচ করে সদস্য পদ পেতে বা ধরে রাখতে আর আগ্রহী থাকবেন না।
জাতীয় পদক-পুরস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি : সব দেশেই সামাজের নানা ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে কিছু অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের উপাধি ও পদক দিয়ে ভ‚ষিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে টাকার অঙ্কে ওইসব পদক ও সম্মানির মূল্য যা, অনেক আগ্রহী পদক প্রার্থীরা তার থেকে অনেক বেশি দাম দিয়ে সেগুলো কিনতে চাইতেন। তবে সামাজিক অবদানের একটা মাপকাঠির বিচারেই পদকগুলো দেওয়া হয়, আর সেজন্যই এগুলো মর্যাদার দিক থেকে মূল্যবান।
তবে যেকোনো সরকারের পদক প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ দুটি বিবেচনা মাথায় রাখে: [এক] সত্যিকার উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করে পদকগুলোর মর্যাদা ধরে রাখা; [দুই] ক্ষমতাশীন সরকারের প্রতি সমর্থন বা আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃত করা। এ দুটি বিবেচনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। দ্বিতীয় বিবেচনা অতিরিক্ত প্রাধান্য পেলে পদকগুলোর মর্যাদাও কমতে থাকে এবং এক সময় দেখা যেতে পারে যে পদকগুলোর এতো অবমূল্যায়ন ঘটেছে যে সরকারের অনুগ্রহভাজনদেরও এগুলো পাওয়ার আগ্রহ কমে গেছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সেরকমটা হতে দেখা যায়। কারণ ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারা আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে যে রকম পারদর্শী, সরকারের প্রশাসনযন্ত্র রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের বিষয়ে সেরকম পারদর্শিতা সাধারণত দেখাতে পারে না। ফলে এসব পদক-পুরস্কার প্রদানের পেছনে সরকারের যে দুটি উদ্দেশ্য থাকে তার কোনোটিই হয়তো শেষ পর্যন্ত আর তেমন পূরণ হয় না।
এই শেষোক্ত উদাহরণটি অর্থনীতির ঢ়ঁনষরপ পযড়রপব তত্তে¡র আওতায় পড়ে, যে তত্তে¡র সূচনা করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস বুকানান (ঔধসবং ইঁপযধহধহ)। এই তত্ত¡ আনুসারে অর্থনীতির আচরণ যেমন ব্যক্তিস্বার্থ ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তেমনি জনস্বার্থে নয় বরং রাজনীতিক ও আমলাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থেই গৃহীত হতে পারে। (বাংলায় অর্থনীতির যে বইটি লিখছি: ‘অর্থনীতি কেনো পড়ি; উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিত’; সেখান থেকে উদ্ধৃত)।
লেখক : অর্থনীতিবিদ। ফেসবুক থেকে