ভবনের ছাদের সিঁড়ি খোলা থাকলে অনেকে বাঁচতে পারতো : ফায়ার সার্ভিস রূপগঞ্জে কারখানায় আগুনে নিহত ৫২
সুজন কৈরী : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ৫২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে অনন্ত অর্ধশতাধিক শ্রমিক। তাদের ইউএস বাংলা ও ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ঐ কারখানায় অগ্নিকা- ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৮টি ইউনিটের ১১০ জন ফায়ার ফাইটার ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন পুলিশ, আনসার, র্যাব, ভলেন্টিায়ার ও জেলা প্রশাসনের লোকজন। দীর্ঘ প্রায় ২০ ঘণ্টা পর শুক্রবার বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস।
আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি অনুসন্ধানে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন।
অগ্নিকা-ে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে ঘটনায় রাষ্ট্রপতি এম আবদুল হামিদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি দুর্ঘটনায় নিহতদের রূহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রপতি অগ্নিকান্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
আগুনে হতাহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
কারখানার শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছয় তলা বিশিষ্ট কারখানার নিচ তলায় অগ্নিকা- ঘটে। পরে আগুন ভবনের অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। আতঙ্কে শ্রমিকরা ছোটাছুটি শুরু করেন। বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন অনেকে। এতে বৃহস্পতিবার রাতেই তিনজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত কারখানা থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ৪৯ জনের মরদেহ। ময়নাতদন্তের জন্য নিহতদের মরদেহ পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। মরদেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এজন্য শুক্রবার বিকেলে নিহতদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা শুরু করে সিআইডির ফরেনসিক টিম। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তাফিজ মনিরের নেতৃত্বে একটি টিম নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করে।
ঢামেক সূত্র জানিয়েছে, মরদেহ শনাক্ত করতে না পারায় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ডিএনএ পরীক্ষা করেই স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। জানা গেছে, প্রথমে ঢামেক মর্গ থেকে মরদেহগুলোর নমুনা সংগ্রহ করা হবে। পরে স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। যাদের সঙ্গে ডিএনএ মিলবে, তাদের পরিবারের কাছে মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
শ্রমিকরা জানান, ভবনের চতুর্থ তলায় ললিপপ, তরল চকলেট, তৃতীয় তলায় জুস, লাচ্ছি, দোতলায় টোস্ট বিস্কুট, বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং নিচতলায় বাক্স ও পলিথিন তৈরির কারখানা ছিল। পঞ্চমতলার একপাশে সেমাই, সেমাই ভাজার তেল, পলিথিন, অপর পাশে কারখানার গুদাম ছিল। কারখানার ষষ্ঠতলায় ছিল কার্টনের গুদাম। টানা দীর্ঘক্ষণ আগুন জ্বলায় ভবনটিতে ফাটলও দেখা দেয়।
কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, দীর্ঘসময় আগুন জ্বলায় কারখানার নিচতলা থেকে পঞ্চমতলা পর্যন্ত ভবনের ভেতরে থাকা সব মালামাল ও মেশিনারিজ পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রমিকরা জানান, কারখানায় বিপুল পরিমাণ তৈরি জুস, নিচতলায় কার্টন এবং পরিত্যক্ত মালামাল, তৃতীয় তলায় প্লাস্টিক গলানোর হিট মেশিন, চারতলায় পশ্চিম পাশে স্টোর রুমে বিপুল পরিমাণ তৈরি প্যাকেট এবং প্যাকেট তৈরির কাঁচামাল ছিল। ছিল এসব কাজে ব্যবহারের জন্য বিপুল পরিমাণ ক্যামিক্যাল। আগ্নিকা-ের দেড় ঘণ্টা পর পাঁচতলা থেকে ফায়ার সার্ভিসের দড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসা শ্রমিক তাজুল ইসলাম জানান, কারখানার ভেতরে নুডুলস, জুস, চকলেট, কেক তৈরি এবং এসব পণ্য প্যাকেটজাত করার জন্য প্লাস্টিকের বিপুল পরিমাণ পণ্য মজুত ছিল। যে কারণে নিচতলায় কার্টনের মধ্যে লাগা আগুন কিছু বুঝে উঠার আগেই ছড়িয়ে পড়ে কারখানা জুড়ে।
তাজুল আরও জানান, বিকেলে স্টোররুম থেকে কিছু মালামাল আনতে গেলে ভবনের নিচতলা থেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনি। সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে ধোঁয়া দেখতে পাই। চেষ্টা করেও কোনও অবস্থাতেই নিচে নামার সুযোগ মিলেনি। পরে বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ওপর পানির ট্যাংকির উপর গিয়ে আশ্রয় নেই। সেখানে আমার মতো আরও ১৩-১৪ জন শ্রমিক আশ্রয় নেন।
বেঁচা আসা অপর শ্রমিক নাজির হোসেন জানান, অগ্নিকা-ের পর প্রচ- ধোঁয়া এবং তাপের কারণে নিচের দিকে নামতে পারছিলাম না। পরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাই। পরে দড়ি বেয়ে অন্য শ্রমিকদের মতো নিচে নেমে আসি। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো ফ্যাক্টরিতে থাকা প্লাস্টিক ও দাহ্য পর্দাথ। এসব কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক সালেহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, কারখানার ভেতরে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, কার্টন ও কাগজ ছিল। যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
শ্রমিকরা বলেন, কারখানার প্রতিটি তলায় একটি করে সেকশন রয়েছে। প্রতিটি সেকশনে একটি করে প্রবেশ ও বের হওয়ার গেট রয়েছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টায় কারাখানটিতে বিস্কুট, চকোলেটসহ নানা রকম খাদ্যদ্রব্য তৈরি হয়। প্রতি শিফটে শ্রমিক ঢোকার পর সেকশনের কলাপশিপল গেট বন্ধ করে দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। শিফট শেষ হলে গেট খোলে কর্তৃপক্ষ।
শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানার নিচে গোডাউনের কার্টনে আগুন লাগার বিষয়টি ওপরে কর্মরত অনেক শ্রমিকই জানতেন না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আগুন পুরো বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। কিন্তু আগুন লাগার পরেও কর্তৃপক্ষ সেকশনে থাকা কেচি গেট খুলছিল না। ফলে অনেক শ্রমিক জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েন। আগুনের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের চিৎকার চেচামেচিতে গেট খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে অনেক শ্রমিক বের হতে পেরেছিলেন। আগুনের ধোঁয়ার কারণে অনেককে সেকশনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতেও দেখতেও দেখেন বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গাড়ির মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, আমরা কিন্তু বাঁচাতে পারতাম। তিনি বলেন, চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল। আর নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন। উনারা নিচের দিকেও আসতে পারেন নাই, তালাবদ্ধ থাকায় উনারা ছাদেও যেতে পারেননি।
অগ্নিকা-ের পর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পুরো এলাকা। কারখানা থেকে মরদেহ বের করার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল পড়ে যায়। কেউ আদরের সন্তান হারিয়ে, কেউ আবার আহাজারি করেন মা-বাবাকে হারিয়ে। প্রিয়জনের দেহাবশেষ ছুঁয়ে দেখতে বুক চাপরাতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
অগ্নিকা-ের ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ঘটে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করেন। তারা কারখানার গেট সংলগ্ন আনসার ক্যাম্প থেকে তিনটি শটগান ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে দুটি শটগান সকালে উদ্ধার হয়। আর অপরটি শুক্রবার বিকেলে জুস কারখানার পাশে একটি ঝোপঝাড়ের মধ্যে কাপড় দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব। সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া-আসার সময় শ্রমিকদের হামলার শিকার হন কয়েকজন সংবাদকর্মীও। এক পর্যায়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যস্ততায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
শুবক্রবার বিকেলে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুলাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের ঘটনা তদন্ত করা হবে। তদন্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাশেম টিবিএসকে বলেছেন, কারখানায় কাজ চললে আগুন লাগতেই পারে। তবে কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল বলে দাবি করেন তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগুনে নিহতদের পরিবারকে দুই লাখ ও আহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষাণা দিয়েছে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, আগুনে নিহতদের মরদেহ সরকারি নিয়ম অনুসারে হস্তান্তর করা হবে।
হস্তান্তরের সময় সরকারি নিয়ম অনুসারে নিহতদের স্বজনদের ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আর যারা আহত হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, অগ্নিকা-ের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগুন লাগার কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি দোষীদের শনাক্ত করবে। অপরদিকে ঘটনা অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসও ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে তদন্তের জন্য ৭ কার্য দিবস সময় দেয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডাম্পিংয়ের কাজ চলছিলো বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।