সমাজ-অর্থনীতির অন্তঃস্থলে অসাম্যের বসতকে মহামারী আরও গভীর ও তীব্র করে দিয়েছে
সুব্রত বিশ^াস
অধিক দক্ষতা বৃদ্ধি, এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্প এবং কর্ম নিযুক্তির জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ শিল্পের অধোগতি হলে কর্মহীনতা বাড়বে। অলাভজনক সংস্থায় পরিণত হবে শিল্প। বেসরকারি সংস্থার কথা আলাদা কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা খাতায়-কলমে স্বতন্ত্র, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সেগুলোর পরিচালকদের ওপর মন্ত্রীদের প্রভাব যথেষ্ট। প্রধান শহরগুলোর পরিকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে সাম্য তৈরি হয়েছে সর্বজনীন তা কিন্তু নয়। যা ঘটছে বহু মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং অল্প কিছু মানুষের আয় ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে, এটাই নতুন। সা¤প্রতিক ইতিহাসে এমন অসাম্য অভ‚তপূর্ব, অন্তত যখন থেকে অর্থনীতি বৃদ্ধির মুখ দেখছে। আর ক্রমবর্ধমান আয় পকেটে আসা সেই ভাগ্যবানদের সৌভাগ্যের বহরও ধাক্কা দেওয়ার মতো। অসাম্যের প্রচলিত সূচক অনুসারে যদি দেখা যায় যে অসাম্য বেড়েছে, তাহলে বুঝতে হবে উচ্চবিত্তের আয় যে হারে বেড়েছে, নিম্নবিত্তের বেড়েছে তার কম হারে। তাহলে অসাম্য বাড়লেও দারিদ্র্যের হার ধারাবাহিক ভাবে কমার কথা।
মহামারী আসলে যা করছে, তা হলো সমাজ-অর্থনীতির অন্তঃস্থলে যে অসাম্যের বসত, তাকেই আরও গভীর ও তীব্র করে দেওয়া। তাই চলতি বছরের জাতীয় উৎপাদনের পুনরুত্থান বাস্তবায়িত হলেও এই অসাম্যকে সামান্যই কমাতে পারবে যদি না বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টনের কোনো নীতি গ্রহণ করা হয়। প্রত্যয়ের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক যে ক্ষীণ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হিসেবে এই দ্বিতীয় পর্যায়ে মহামারীর তীব্রতা স্পষ্টতই অনেক বেশি। আক্রান্তদের চিকিৎসা বাবদ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক খরচ এবার লাগামছাড়া। অনেক পরিবারই শুধু চিকিৎসার খরচ কিংবা একমাত্র রোজগেরে মানুষকে হারিয়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে গিয়েছে। তাছাড়া নতুন করে কাজ হারানো তো আছেই। এমন শত শত স্পর্শকাতর বিষয় আছে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গভীর মনোযোগ হয়ে পরিচালনা করতে হবে। অসাম্যের কথা ভাবতেই যেখানে নীতিনির্ধারকরা রাজি নন, সেখানে কী করতে হবে বলতে যাওয়া অর্থহীন। বলছেন তো অনেকেই। আয়কর কিংবা সম্পত্তিকর বাড়ানোর কথা উঠেছে আগেই। বারবার বলার প্রয়োজন আছে? আশ্চর্যের কথা, স¤প্রতি কিছু জোরালো দাবি এলেও সরকার স্বাস্থ্যবিষয়ক অত্যাবশ্যক পণ্যেও কর শূন্যে নামিয়ে আনতে রাজি নয়। এখানে বলা প্রয়োজন কর, আয়কর বা সম্পত্তিকর না বাড়িয়ে শুধু বিক্রয় করের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতারও একটি অবাঞ্ছিত পরিণতি আছে। অসাম্য বেড়ে যায়। প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থায় বেশি আয়ের মালিককে আনুপাতিক ভাবে বেশি কর দিতে হয়। কম আয়ে যদি দিতে হয় আয়ের দশ শতাংশ, বেশি আয়ে দিতে হয় ত্রিশ শতাংশ।
অর্থনীতিতে যাকে বলে ‘ডাউনসাইড রিস্ক’, তা থেকে সুরক্ষার জন্যে সভ্য সমাজে ভাবনাচিন্তার রেওয়াজ আছে। আচম্বিতে জীবনধারণের সম্বলটুকু হারানোর চেয়ে বড় বিপর্যয় বোধহয় আধুনিক মানবজীবনে আর কিছু নেই। মহামারীকালে অধিকাংশ এই পতন ঝুঁকির বিপরীতে দেখছি কতিপয় মানুষের বিত্তের অস্বাভাবিক স্ফীতি। অর্থনীতির পুনরুত্থান কোনো এক সময়ে বাস্তবায়িত হলেও এই অসাম্যের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনটুকু আমাদের নীতিনির্ধারকরা দেখাবেন না। লেখক : ব্যবসায়ী।