ঈদ ঘিরে প্রস্তুত সাভারের চামড়া শিল্প নগরী
বাসস : দেশে প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি গবাদিপশুর চামড়া ক্রয় করা হয়, যার ৮০ ভাগ চামড়াই সংগ্রহ করা হয়ে থাকে কোরবানির ঈদকে ঘিরে। চামড়া সংগ্রহের এ মৌসুমে লাখ-লাখ টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন দেশের প্রান্তিক ব্যবসায়ীরাও।
করোনা মহামারিতে চামড়া ব্যবসায় একদিকে যেমন আর্ন্তজাতিক বাজারে ধস নেমেছে, পাশাপাশি দেশীয় বাজারে সর্বনিম্ন দরে বিক্রি হচ্ছে চামড়া। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পরোপুরি চালু না হওয়ায় উন্নত বিশ্বে সরাসরি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে লকডাউনে দেশ, এতে রয়েছে শ্রমিক ও পরিবহন সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা। প্রতিবারের মতো আসছে কোরবানির ঈদেও কাঁচা চামড়ার বড় জোগান তৈরি হবে। যা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে শংকায় পড়েছেন শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
দেশের চামড়া খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ছয় লাখ এবং পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। চামড়া খাতে নিয়োজিত শ্রমিক সোহেল মিয়া, শাহজাহানসহ আরও অনেকে জানালেন ট্যানারি শিল্পে তাদের কর্মপরিবেশের কথা, জানালেন আসছে কোরবানির ঈদকে ঘিরে তাদের কর্মব্যস্ততার কথা।
পাইকারী ব্যবসায়ী সোবাহান মিয়া জানালেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারনে গেলো কয়েক বছর ধরে কোরবানির ঈদে চামড়া শিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এ ধরনের বিশৃঙ্খলা বন্ধে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অতি উৎসাহী হয়ে চামড়া না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, চামড়ার ব্যবসা যারা না বুঝেন, তাদের এ ব্যাবসায় না আসাই ভালো। চামড়া ক্রয়ের পর তা সংরক্ষণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয় তা অনেকেই জানে না। এতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও ট্যানারি শিল্পের সিইটিপি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ট্যানারি মালিকদের মাঝে বাড়তি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা।
গেলো বছরের চামড়াও এখনো পড়ে রয়েছে ট্যানারিগুলোতে। ট্যানারি মালিকরা প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে প্রগতি ট্যানারির মালিক শামসুল আলম স্বজন জানান, বাজারের চাহিদানুযায়ীই ট্যানারি মালিকরা চামড়া ক্রয় করবে। তিনি বলেন, এবার অত্যাধিক গরমের মধ্যে কোরবানির ঈদ হওয়ায় অনেকটা শঙ্কা রয়েছে, যার কারণে এবার চামড়া সংরক্ষণেও নিতে হবে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, চামড়া সংগ্রহের করে সন্ধ্যার পর ট্যানারিতে আসতে শুরু করবে চামড়া। এপর্যন্ত চামড়াগুলোর গুণগত মান ঠিক থাকবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এজন্য তিনি যারা কোরবানি দেবেন তাদের প্রতি নিজ দায়িত্বে চামড়াগুলোতে লবন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এগুলো দেশের সম্পদ, আমাদেরই এর গুনগত মান রক্ষা করে বাজারজাত করতে হবে।
এছাড়াও লবণের জন্য আলাদা দাম দিয়েই চামড়া ক্রয় করা হবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, করোনাকালে শ্রমিক সংকট বড় সমস্যা হতে পরে ট্যানারি মালিকদের। তবে সরকার যদি পণ্য পরিবহন যাতায়াত স্বাভাবিক রাখতে পারে তাহলে এসব সংকট উত্তরন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে সেন্ট্রাল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পুরোপুরি বুঝিয়ে না দেওয়ায় ট্যানারী মালিকরা সমস্যায় পড়তে পারে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে পরিবেশের দোহাই দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বাড়তি চাপ দিতে পারে।
চামড়া শিল্পনগরীর সেন্ট্রাল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়ায় আশেপাশের পরিবেশও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশেপাশের গ্রামবাসীও। উপজেলার তেতুঁলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমর জানান, কোরবানীর ঈদে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ট্যানারি কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখওয়াত উল্লাহ জানালেন, গেলো বছরের ন্যায় এবারও ৮০ লাখ গবাদিপশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবারের কোরবানির ঈদে, পরিবহন সংকট কেটে গেলে অনেকটাই স্বাভাবিক হবে চামড়া শিল্প। তিনি বলেন, করোনার কারণে লকডাউন শিথিলে গবাদিপশু বেচা-কেনা স্বাভাবিক হলে কোন ধরনের বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি আরও বলেন, সিইটিপি নির্মানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাইনিজ কোম্পানি গত ৩০ জুন কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বিসিকের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিসিক একটি কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে তাদের কাছে সিইটিপি’র দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা কাজ শুরু করলেই বোঝা যাবে। তবে কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে যা সংস্কার না করলে বাধার সম্মুখীন হবে ট্যানারি মালিকরা।
তবে বিসিক চামড়া শিল্প নগরী ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জে, এন, পল জানালেন, বর্তমানে প্রস্তুত রয়েছে দেশের অন্যতম রপ্তানি আয়ের খাত চামড়া শিল্প, যা সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে কাজ করছে বিসিক। তিনি বলেন, প্রতিবছরই কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ট্যানারি শিল্প নগরীতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবারও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিসিক। এরমধ্যে অন্যতম সিইটিপি। সিইটিপি পরিস্কারের কাজ চলছে। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেন ২৪ ঘন্টা এখানে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইটিপি ফাংশনিং করার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা অ্যাডভান্সড ২ মাসের কেমিক্যাল কিনে রেখেছি যাতে প্রয়োজনের সময় চাহিদা পূরণ করা যায়। নিরবিচ্ছিন্ন পাওয়ার ও পানি সাপ্লাইয়ের জন্য দায়িত্বরতদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং টীম গঠন করা হয়েছে যারা সার্বক্ষণিক তদারকি করবে সম্পূর্ণ কার্যক্রম যাতে সংকট নিরসন সম্ভব হয়। এছাড়াও ঈদের দিন ও পরের দিনগুলোতে অতিমাত্রায় সরাসরি ট্যানারিতে চলে আসা চামড়া ব্যবস্থাপনায় যেন কোন সমস্য তৈরি না হয় সেজন্য আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি আর বলেন ১ টন চামড়া প্রসেস করতে আমাদের ৩৩ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের ট্যানারি মালিকরা ওইভাবে স্বীকৃত না। তার প্রয়োজনের অনেক বেশি পানি ব্যবহার করে থাকে। এটা অন্যান্য সময় ঠিক থাকলেও কোরবানির ঈদে পানির ঘাটতি তৈরি করা হয়। আমাদের সিইটিপির ক্যাপাসিটি প্রতিদিন ২৫ হাজার কিউবেক মিটার।
তিনি বলেন, সবকিছু মিলিয়ে সমস্যা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি সংকট উত্তরণে বিসিকের পক্ষ থেকে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।