চাঙ্গা শেয়ারবাজারে দেড় মাসে বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ ২ লাখ ৮৩ হাজার
মাসুদ মিয়া : দেশের শেয়ারবাজার কয়েক মাস ধরে চাঙ্গা ভাব রয়েছে। চাঙ্গা শেয়ারবাজারে গত দের মাসে বিনিয়োগকারীদের বেশি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট হিসাব বন্ধ হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার। এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাৎসরিক নবায়ন মাশুল দিয়ে হালনাগাদ না করায় এসব হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ হিসাবধারীরা বছর শেষে মাশুল দিয়ে হিসাবগুলো সচল রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। বিও হিসাব সক্রিয় রাখতে বার্ষিক ৫০০ টাকা মাশুল নির্ধারিত রয়েছে সিডিবিএলের। সাধারণত ৩০ জুনের মধ্যে এ মাশুল পরিশোধ করতে হয় বিও হিসাবধারীদের। যেসব হিসাবের বিপরীতে মাশুল পরিশোধ করা হয় না, জুলাই মাস থেকে সেসব হিসাব ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিও হিসাব খোলাসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুন পর্যন্ত বিও হিসাব ছিল ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯২৮টি। ১৫ জুলাই বিও কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৭টি। গত দেড় মাসে কমেছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৯১টি বিও হিসাব।
এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আট থেকে ১০ লাখ বিনিয়োগকারী সক্রিয়, বাকি ১৩ থেকে ১৪ লাখ ছিল নিস্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয় হিসাবের মধ্যে সাত থেকে আট লাখ হিসাবধারী রয়েছেন যারা আইপিওতে (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) আবেদন করেন। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয় লাখ বিওধারী বাজার ছাড়ছেন।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, কয়েকটি কারণে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছাড়ছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) নতুন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে লটারি প্রথা উঠে গেছে। এখান যারাই আবেদন করছেন তারা সবাই সমহারে শেয়ার পাচ্ছেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন নিয়মের আইপিও ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। এ কারণে হতাশ হয়ে বাজার ছাড়ছেন অনেকে। নতুন পদ্ধতিতে আইপিওতে আবেদন করতে হলে বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থাকতে হবে। অর্থাৎ ২০ হাজার টাকার শেয়ার থাকতে হবে। পাশাপাশি আইপিওতে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার আবেদন করতে হবে।
আগে যেখানে লেনদেন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ টাকার শেয়ার সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ত, সেখানে এখন দুই সপ্তাহে ১০ টাকার শেয়ার ২০ টাকাও উঠছে না। পক্ষান্তরে আইপিও ব্যবসার চেয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ বিও হিসাব ব্যবহার করে আইপিও ব্যবসা করছিলেন তারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন
এদিকে, তালিকাভুক্ত হওয়ার পর নতুন কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর প্রথম দিন থেকেই সার্কিট ব্রেকার আরোপ করায় শেয়ারের দাম বাড়ছে খুব ধীরে। ফলে আগে যেখানে লেনদেন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ টাকার শেয়ার সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ত, সেখানে এখন দুই সপ্তাহে ১০ টাকার শেয়ার ২০ টাকাও উঠছে না। পক্ষান্তরে আইপিও ব্যবসার চেয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০ বিও হিসাব ব্যবহার করে আইপিও ব্যবসা করছিলেন তারা এখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।
আইপিওর নতুন নিয়মের পাশাপাশি বিও হিসাবের বার্ষিক ফি না দেওয়ায় বেশকিছু বিও বন্ধ হচ্ছে। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এখন থেকে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের চিত্র আমরা দেখতে পাব। প্রকৃত পক্ষে যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চান তারা বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হবেন
এমনই একজন বিনিয়োগকারী শাকিল রিজভী সিকিউরিটিজের বিও হিসাবধারী বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন মিলে আমার ৪০টি বিও হিসাব ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি হিসাব দিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যবসা করতাম। ৩৫টি বিও দিয়ে আইপিওতে আবেদন করতাম। পাঁচ হাজার টাকা করে পৌনে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করা লাগত এখানে।
তিনি আরও বলেন, ৩৫টি বিও হিসাব দিয়ে কমপক্ষে আট থেকে ১০টি আইপিও পেতাম। চার থেকে পাঁচ হাজার শেয়ার হাতে আসত। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে ওই টাকায় এখন মাত্র ছয়টি বিও হিসাব দিয়ে আবেদন করা যাচ্ছে। শেয়ার পাচ্ছি মাত্র ১০২টি। অর্থাৎ আমার ৩৫টি হিসাব আর দরকার নেই। তাই এগুলো বন্ধ করে দেব।
হঠাৎ করে বিও হিসাবধারীদের চলে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আইপিওর নতুন নিয়মের পাশাপাশি বিও হিসাবের বার্ষিক ফি না দেওয়ায় বেশকিছু বিও বন্ধ হচ্ছে। এটা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের চিত্র আমরা দেখতে পাব। প্রকৃত পক্ষে যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চান তারা বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হবেন।
জামানত ও ঝুঁকি ছাড়াই এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী আইপিও ব্যবসা করেছেন। নতুন নিয়মে তারা হতাশ হয়েছেন। আগের মতো তারা আইপিও শেয়ার পাচ্ছেন না, আবার দ্রুত মুনাফা তুলেও নিতে পারছেন না। তাই নিরাশ হয়ে বাড়তি বিও হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছেন
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, নতুন পদ্ধতিতে ইতিমধ্যে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার কোম্পানির আইপিও শেয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোম্পানি দুটির মধ্যে সোনালী লাইফে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ১৭টি শেয়ার পান বিনিয়োগকারীরা। যা টাকার অঙ্কে ১৭০। অপর কোম্পানি বারাকা পতেঙ্গার আইপিওতে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পাওয়া যায় ৫৪টি শেয়ার। অর্থাৎ ৫৪০ টাকার শেয়ার পান বিনিয়োগকারী।
যেসব বিনিয়োগকারীর শত শত বিও হিসাব ছিল, তারা এসব বিও দিয়ে আইপিওতে আবেদন করতেন। এগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। এ সংখ্যা বেশ বড় অঙ্কের। তারা আইপিও শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করে টাকা তুলে নিতেন। এর প্রভাব পড়ত সেকেন্ডারি মার্কেটে। এখন আর সেই সুযোগ নেই।