সড়কে তৎপর পুলিশ র্যাব বিজিবি সেনাবাহিনী ঈদের ছুটি শেষে শুরু হয়েছে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ
সুজন কৈরী : করোনার সংক্রমণরোধে ঈদুল আযহার ছুটি শেষে শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। এজন্য ঢাকামুখী হয়েছেন বিভিন্ন জেলার অনেক মানুষ। কিন্তু ঢাকায় এসেই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে কর্মজীবী এসব মানুষদের। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার যানবাহন না পেয়ে বিপাকে পড়েন হাজারো মানুষ। সঙ্গে থাকা ব্যাগ আর শিশু সন্তানকে নিয়ে অনেকেই হেঁটে যান গন্তব্যে।
বিধিনিষেধের প্রথম দিন রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলো ফাঁকা দেখো গেছে। সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, পণ্যবাহী কিছু বাহন ও রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। পাড়া-মহল্লায় চায়ের দোকান খোলা এবং সেখানে আড্ডা দিতে দেখা গেছে মানুষদের। বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। কঠোর বিধিনিষেধে সড়কের অবস্থা দেখতে বের হয়েছেন অনেকেই। এছাড়া কেউ কেউ বের হয়েছেন হাসপাতালে যেতে, আবার কেউবা বাজার করার অজুহাতে।
বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রাস্তায় বের হওয়াদের অনেককেই যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় জরিমানা করতে দেখা গেছে। প্রতিটি সড়কে ছিলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সরব উপস্থিতি।
চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চান চান দায়িত্বরতরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, বিধিনিষেধ মানাতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সঙ্গে ভ্রাম্যমান আদালত ও সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে। চেকপোস্টগুলোতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যানবাহনের গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে চেকপোস্টগুলোতে। জরুরি প্রয়েজনে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করতে পারলেই ছাড় পাচ্ছেন বের হওয়া মানুষ। অন্যথায় মামলা বা জরিমানা করা হচ্ছে। কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধ ছাড়া প্রায় সব ধরনের দোকান বন্ধ রয়েছে।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসা আলমগীর হোসেন বলেন, আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোভাবেই ঢাকায় পৌঁছেছি। কিন্তু সদরঘাটে নেমেই পড়তে হয়েছে বিপাকে। বিধিনিষেধের কারণে সবকিছুই বন্ধ। অনেক চেষ্টা করেও দক্ষিণখানের বাসায় যেতে একটি রিকশা ঠিক করতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে শিশু সন্তান ও সঙ্গে থাকা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা ধরেছি। আলমগীরের মতো একই অবস্থা দেখা গেছে দেশের দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় ফেরা মানুষের। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও একটি যানবাহন পাননি তারা। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আবার কেউবা দুই-তিনগুন বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশা অথবা ভ্যানে করে ফিরেন নিজ নিজ গন্তব্যে।
বিধিনিষেধের কারণে যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় প্রবেশ করতে না দেওয়ায় রাজধানীর প্রবেশ পথগুলোতে ঢাকায় ফেরা মানুষদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। রাজধানী থেকে দূরে বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হয়। শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর অন্যতম প্রবেশ পথ গাবতলীতে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা ছেড়ে আসা দূরপাল্লার বিভিন্ন বাস একে একে রাজধানীতে ঢুকছিলো। তবে টার্মিনালে ঢোকার আগেই গাবতলী ব্রিজের পাশে যাত্রী নামিয়ে পুলিশ খালি বাসগুলো পাঠিয়ে দেয় বাস টার্মিনালে। এছাড়া অনেক বাস আমিনবাজারে এসে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছিলো। এজন্য অনেক যাত্রী আমিন বাজার থেকে হেঁটে গাবতলী দিয়ে রাজধানীতে ঢুকেন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীতে আসা যাত্রীরা বলেন, পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে গিয়েছিলেন তারা। ঈদ কাটিয়ে ফিরে এসেছেন। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরা মাহমুদ বলেন, ভোরে পৌঁছানোর কথা থাকলেও রাস্তায় জ্যামের কারণে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। ফরিদপুর থেকে পরিবার নিয়ে আসা আলামিন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রাত ১২টায় রওনা দিলেও সড়কে জ্যামের কারণে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। পুলিশকে টোল দেওয়ার রিসিট দেখিয়ে রাজধানীতে ঢোকেন তিনি।
দায়িত্বরত পুলিশ ইন্সপেক্টর কামরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ঢোকার সময় প্রতিটি যানবাহনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষই ঈদ শেষে রাজধানীতে ফিরছেন। সেজন্য যাত্রী এবং যানবাহনের চাপ সকাল থেকে একটু বেশি। যারা যাত্রী নিয়ে এসেছেন সেসব গাড়ি, বিশেষ করে ঘাটের গাড়িগুলোর টোল আদায়ের রিসিট চেক করে যেতে দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর রাসেল স্কয়ার মোড়ে বসানো পুলিশি চেকপোস্টে দেখা যায়, সকালে হানিফ, শ্যামলী, এম. ট্রাভেল ও রাজধানীর দেওয়ান পরিবহনসহ কয়েকটি বাসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। প্রতিটি বাসকে ২ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
জরিমানা করার পর শ্যামলী পরিবহনের সুপারভাইজার শাওন বলেন, কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেছি। সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পার্কিং করব। রাস্তায় জ্যাম থাকায় আসতে দেরি হয়েছে। তাই পুলিশ মামলা দিয়েছে।
চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করা ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদ আহসান বলেন, বিধিনিষেধে গণপরিবহন চলার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে রাজধানীতে প্রবেশ করা বাসগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে।
আমিন বাজার ব্রিজে চেকপোষ্ট পরিচালনার নেতৃত্ব দিচ্ছিলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি এ এস এম মাহতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ চলাকালে কোনো যানবাহন চলাচল করবে না। তিনি বলেন, ঈদ শেষে অনেক যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। আমরা গাড়িগুলো থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। যদি বিধিনিষেধের মধ্যে পড়ে, তো ছেড়ে দিচ্ছি।
তবে যে যানবাহনের যাত্রীরা সন্তুষ্টিজনক উত্তর দিতে পারছেন না, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দূরপাল্লার গণপরিবহন সম্পর্কে ডিসি মাহতাব বলেন, যখন দূরপাল্লার বাসগুলো রওনা দিয়েছিলো তখন বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু ঢাকায় প্রবেশের আগেই তারা বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে। তাই যাত্রীদের নামিয়ে বাসগুলো টার্মিনালে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ডিসি মাহতাব বলেন, যাত্রী সাধারণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। যাদের মাস্ক নেই তাদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে।
গাবতলীতে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ মোর্শেদ মিশু বলেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে যারা বের হচ্ছেন, যৌক্তিক কারণ না দেখাতে পারলে আমরা তাদের মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং জরিমানা করা হচ্ছে।
এদিকে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করায় শুক্রবার ৪০৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির ৮টি বিভাগের ৫১টি থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এছাড়া ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ২০৩ জনকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২৭০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ডিএমর্পি ট্রাফিক বিভাগ ৪৪১টি গাড়িকে ১০ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে যারা যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাইরে বের হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএমপি।