প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতে বৃক্ষের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ
আবদুর রহমান
বৃক্ষ প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এদের ছাড়া মানব জীবন অচল। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে। গাছ ও বৃক্ষ সে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে অক্সিজেন ত্যাগ করে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
শুধু তাই নয়, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, আসবাবপত্র, যানবাহন, কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ছায়া, জ্বালানি কাঠ প্রভৃতির যোগান দিতে বৃক্ষের জুড়ি নেই। কাঠ ও ছায়াদান ছাড়াও সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর ফল পেতে ফল গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ ভূমি ক্ষয়রোধ করে মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় এবং বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভূমি ও বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা বাড়ায়। তাছাড়া ঝড়-ঝাঞ্ছাও সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসের তান্ডবতা হতে দেশের লোকজন ও পশু পাখি রক্ষা করে। বৃক্ষ, বন্যা ও খরা রোধে সহায়ক। সুতরাং গাছ আমাদেও পরম বন্ধু।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোন দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার মোট ভূখন্ডের অন্তত: শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ শতকরা ১৮ ভাগ মাত্র। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে ব্যাপকহারে গাছপালা কাটা হচ্ছে। কিন্তু সে হারে বৃক্ষরোপণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। ফলে গাছপালার ঘাটতির কারণে একদিকে যেমন আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় গাছপালাজাত দ্রব্যের অভাব ঘটছে, অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বন্যা, খরা, উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণি, বুলবুল, আম্ফান ও ইয়াসের মতো মারাত্মক সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস, ভূমিক্ষয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উত্তরাঞ্চলে মরু বিস্তারের আশংকা ইত্যাদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতির মোকাবেলায় সত্যিকারের দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে প্রতিটি নাগরিকের অধিক বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের দায়িত্বভার হাতে নিতে হবে। আশার কথা, বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ও নির্মল পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে জাতীয়ভাবে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কাজেই, নিজের প্রয়োজন, জাতীয় স্বার্থে ও দেশের কল্যাণে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সকলকেই বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও তা সংরক্ষণের কাজে ব্রতী হতে হবে।
এখন বর্ষাকাল। বৃক্ষের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। আপনার নিজের সম্পদ এবং জাতীয় সম্পদ বাড়ানোর জন্য বসতবাড়ির আশেপাশের পতিত জায়গায়, পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে, খাল বা নদীর ধারে,রেল লাইন ও বাঁধের পাশে, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ঈদগাহ, গোরস্থান, শ্মশান ও মন্দিরের খালি জায়গায় ব্যাপক হারে গাছ লাগানো উচিত। আসবাবপত্র ও গৃহ নির্মাণের জন্য সেগুন, মেহগিনি, শিলকড়ই, গজারী, জারুল এবং জ্বালানি কাঠের জন্য কড়ই, ইপিল-ইপিল,রেইন্ট্রি তেঁতুল, বাবলা ইত্যাদি এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল যেমনÑ আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, সফেদা, জামরুল, আমড়া, বেল, লেবু, কামরাঙা, নারিকেল ইত্যাদির উন্নত চারা/কলম সংগ্রহ করে লাগাতে হবে। এছাড়া নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য নিম, অর্জুন, হরিতকি, বাসক, আমলকি, তুলসি, বহেরা, মহুয়া এসব ঔষধি গুণ সম্পন্ন বৃক্ষের চারা রোপণ করা উচিত।
বৃক্ষের চারা রোপণের নিয়মাবলী : বৃক্ষের চারা রোপণের কতিপয় মৌলিক নিয়ম-কানুন রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ না করলে কাংখিত ফল লাভ করা যায় না। নির্দিষ্ট দূরত্বে বৃক্ষের চারা রোপণ করতে হবে। কেননা, সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ না করলে ছায়ার কারণে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয় না। বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের উত্তম দূরত্ব হলো ২ ী ২ মিটার বা ২.৫ী২.৫ মিটার। জ্বালানির জন্য যদি ইপিল-ইপিল লাগানো হয় তবে ১ী১ মিটার দূরত্বে লাগানো যেতে পারে। বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের জন্য ৪৫ সে.মি. লম্বা, ৪৫ সে.মি. চওড়া ও ৪৫ সে.মি. গভীর করে গর্ত করে গর্তের মাটি ১০-১২ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। প্রতিটি গর্তের ওপরের স্তরের মাটির সাথে পঁচা গোবর বা আবর্জনা সার ৬ কেজি, ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম ও ১২৫ গ্রাম এম,ও,পি সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্তটি পুনরায় ভরাট করতে হবে। গর্তের ভরাট মাটি জমির সাধারণ সমতল হতে ৫ সে.মি. (২ ইঞ্চি) পরিমানে উঁচু রাখতে হবে।
সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে ১০-১২ দিন পর গর্তের ঠিক মাঝখানে চারা বসিয়ে চারপাশের মাটি হাত দিয়ে হালকাভাবে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে গোড়ায় আরও কিছু মাটি দিয়ে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। যাতে চারার চারপাশের মাটি জমির সমতল থেকে একটু উঁচু ও ঢালু অবস্থায় থাকে। এতে করে চারা গাছের গোড়ায় বর্ষার পানি জমতে পারে না। চারা রোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনক্রমেই গাছের গোড়ায় শিকড়সহ মাটির বলটি ভেঙে না যায়। পলিথিন ব্যাগ বা টবে চারা/কলম সংরক্ষিত থাকলে ব্যাগ বা টব সাবধানে খুলতে হবে। চারার গোড়ায় যে পর্যন্ত মাটি থাকে লাগানোর সময় ঠিক ততটুকু গর্তে পুঁতে দিতে হয়। চারা রোপণের পর বর্ষা না হলে গোড়ায় পানি সেচ দিয়ে গর্তের মাটি ভাল করে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ঝড়ে বা বাতাসে চারা হেলে বা পড়ে না যায় সেজন্য গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে একটি শক্ত খুঁটি পুঁতে তার সাথে চারা বেঁধে দিতে হয়। গরু ছাগলের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য চারা গাছের চারদিক মজবুত ঘের-বেড়া দিতে হবে। ঘের- বেড়া দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চারা আলো-বাতাস পায় এবং ডালপালা ছড়িয়ে পড়ার জন্য উপযুক্ত ফাঁকা স্থান থাকে। সাধারণত বাঁশ দিয়ে বেড়া নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি চারার জন্য ২৫০ সে.মি. উঁচু খাঁচি দ্বারা বেড়া দেয়া যেতে পারে। চারা ঠিক মাঝখানে রেখে খাঁচি বসিয়ে খাঁচির দু’পার্শ্বে ২টি খুঁটি পুঁতে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, বৃক্ষ রোপণ করার ন্যায় রোপিত চারার যতœ ও সংরক্ষণ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রোপিত চারার সুষ্ঠু পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর অনেক চারা নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোপিত বৃক্ষের চারা যতœ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে চারা গাছকে বড় গাছে পরিণত করতে হবে।
লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা