ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক খাতের শেয়ার পতনেও শেয়ারবাজারে চার রেকর্ড ডিএসইতে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন
মাসুদ মিয়া : দেশের শেয়ারবাজারে প্রতিদিন কোন না কোন রেকর্ড হচ্ছে। গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবার শেয়ারবাজারে চার রেকর্ড হয়েছে। এদিন ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক খাতের শেয়ারে পতনের দিনে চমকে দেখিয়াছে খাদ্য, বস্ত্র, বীদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলোর বড় উত্থান হয়েছে এতে আরও উচ্চতায় উঠেছে দেশের শেয়ারবাজার।
এদিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকসহ বাকি দুটি সূচকও ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে বাজার মূলধন। লেনদেনও ইতিহাস সৃষ্টির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রায় ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের দেখা মিলেছে শেয়ারবাজারে।
একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টির মধ্যে ডিএসইতে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণও। বাজারটিতে দিনভর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। যা ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে ৩ হাজার ২৪৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়।
এ বিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গতি ফিরতে শুরু করে শেয়ারবাজারের। গড়তে থাকে একের পর এক নতুন নতুন রেকর্ড। এটা বাজারের জন্য ইতিবাচক। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী এহতেশামুজ্জামান বলেন, চাঙ্গা বাজারে ব্যাংকের শেয়ারের দর কমা হতাশাজনক। তিনি বলেন, অধিকাংশ ব্যাংক মুনাফা করেছে তারপরও ব্যাংকের শেয়ারের দর কমা বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই হতাশাজনক। গত একবছরে আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দেখলাম ব্যাংকের ঘোষিত লভ্যাংশ অনেক আকর্ষণীয় এবং ব্যাংকের শেয়ার প্রতি ইপিএস অনেক ভাল, তার পর ব্যাংকের শেয়ারের দর সেই হারে বাড়ছে না।
এহতেশামুজ্জামান আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিৎ মন্দ অর্থাৎ দুর্বল মৌলভিত্তিক কোম্পানির শেয়ারের দাম যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর রাখা। দুর্বল কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কখনো ভালো লভ্যাংশ দেয় না।
আরেক বিনিয়োগকারী কাজী আব্দুল রাজ্জাক বলেন, ব্যাংক আন্ডার ভ্যালুড, এখান থেকে অনেক বাড়ার সুযোগ আছে। আশা করি সামনে ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়বে।
গতকাল ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ অন্য খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতনের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়।
এতে লেনদেনের ৩৩ মিনিটের মাথায় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ৭৩ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর থেকেই ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে খাদ্য, বস্ত্র, বীদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলো। পতনের ধকল কাটিয়ে এই খাতগুলোর কোম্পানির শেয়ার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রকৌশল খাত। ফলে ধসের কবল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বড় উত্থান দিয়ে শেয়ারবাজারের লেনদেন শেষ হয়।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত খাদ্য খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে চারটির। বস্ত্র খাতের ৩৬টি কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার বিপরীতে দাম কমেছে ১৯টির।
এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২০টি কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার বিপরীতে তিনটির দাম কমেছে। ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ২২টির এবং দাম কমেছে আটটির। আর প্রকৌশল খাতের ৩৩টির শেয়ার দাম বাড়ার বিপরীতে দাম কমেছে আটটির।
খাদ্য, বস্ত্র, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশল এবং ওষুধ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ায় দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে সব খাত মিলে ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বীপরীতে ১৭৩টির দাম কমেছে এবং ২০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এতেই ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ৩২ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৬২৮ পয়েন্টে উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৫ হাজার ৫৫পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রথমবারের মতো ৬ হাজার ছয়শ পয়েন্টের মাইলফলক পেরিয়ে গেল।
প্রধান মূল্য সূচকের পাশাপাশি উত্থান হয়েছে ডিএসইর অপর দুই সূচকেরও। এর মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ৩৯২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এ যাবতকালের মধ্যে এটি ডিএসই-৩০ সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান।
অপরদিকে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ১২ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৪৫২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ১ হাজার সাড়ে চারশ পয়েন্ট স্পর্শ করল।
এদিকে শুধু মূল্য সূচক নয় ডিএসইর বাজার মূলধনও এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। সোমবার লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এর আগে কখনো ডিএসইর বাজার মূলধন এমন উচ্চতায় ওঠেনি।
বড় অঙ্কের এই লেনদেনের দিনে টাকার পরিমাণে ডিএসইতে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির ১৫২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওরিয়ন ফার্মার ৭১ কোটি ৬০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৬০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ন্যাশনাল পলিমার, জিপিএইচ ইস্পাত, এসএস স্টিল, জিনেক্স ইনফোসিস, মালিক স্পিনিং, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো এবং ফু-ওয়াং সিরামিক।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ১০১ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ৩২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫৭টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৪৪টির এবং ২০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।