কোচিং সেন্টারের শিক্ষক থেকে ইভ্যালির সিইও ইভ্যালির দায়-দেনা হাজার কোটি টাকার বেশি
সুজন কৈরী : আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন পদাধিকার বলে নিজেরা মাসিক ৫ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা বেতন নিতেন। তারা কোম্পানির টাকায় রেঞ্চ রোভার ও অডি ব্রান্ডের ব্যক্তিগত দুটি দামি গাড়ি কিনে ব্যবহার করতেন।
প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৫-৩০টি যানবাহন রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সাভারে গ্রেপ্তার রাসেলের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গা-জমিসহ অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। ইভ্যালির কর্মরত অনেকের বেতন চলতি বছরের জুন মাস থেকে বেতন বকেয়া রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দায় দেনার পরিমান ১ হাজার কোটি টাকারর বেশি। গ্রেপ্তারের পর র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য জানিয়েছেন রাসেল ও শামীমা দম্পতি।
শুক্রবার রাজধানীর কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন রাসেল।
ব্যবসায়িক ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছেন, প্রথমত একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এরপর দায়সহ কোনও প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে লভ্যাংশ নিয়ে নেওয়া। এ উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেছেন। অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে কোম্পানি শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়া। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভূক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা নেন রাসেল। দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করার আবেদন একটি অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে দেওলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করেছিলেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের কোম্পানির দায় ও দেনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা। চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমান দায়ের বিষয়ে গ্রেপ্তারকৃতরা কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
দায়ের সর্বমোট পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানি কোম্পানি, কোনও ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হতো। ফলে দেনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল আরও জানান, ইভ্যালি ছাড়াও তার আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে। এর মধ্যে ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি দিয়েই ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়া। তিনি বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন, যাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি করা যায়।
ইভ্যালির গ্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখেরও বেশি। তিনি বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এত সংখ্যক গ্রাহক তৈরি করেছেন। বিক্রি বাড়ায় গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদাও বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, গাড়ি, গৃহস্থালি, প্রসাধনী, প্যাকেজ ট্যুর, হোটেল বুকিং, জুয়েলারি, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ও ফার্নিচার পণ্যগুলো বেছে নেওয়া হয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় রাসেল দম্পতি। এসব পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল আকারে দায় তৈরি হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ দায় ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির নেওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরি হত, দায় তত বৃদ্ধি পেত। গ্রেপ্তার রাসেল জেনেশুনে এই নেতিবাচক স্টাটিজি গ্রহণ করেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
কমান্ডার মঈন বলেন, ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি পেমেন্ট গেটওয়েতে গ্রাহকের ৩০-৩৫ কোটি টাকা আটকে আছে বলে রাসেল জানিয়েছেন। অর্থাৎ ঐ অর্থ কোম্পানির নয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানিয়েছেন, ইভ্যালির কারসাজির মূলহোতা রাসেল। স্ত্রী তার অন্যতম সহযোগী। রাসেল ২০০৭ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরে তিনি ২০১৩ সালে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন।
২০১১ সালে তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরি শুরু করেন। তিনি প্রায় ৬ বছর ব্যাংকে চাকরি করেন। ২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন রাসেল।
প্রায় এক বছর শিশুদের ব্যবহার্য একটি আইটেম নিয়ে ব্যবসা করেন এবং এরপর তিনি ঐ ব্যবসা বিক্রি করে দেন। ২০১৮ সালে আগের ব্যবসালব্ধ অর্জিত অর্থ দিয়ে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু হয়। কোম্পানিতে তিনি সিইও ও তার স্ত্রী চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন।
ইভ্যালির ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভাড়া করা স্পেসে ধানম-িতে প্রধান কার্যালয় এবং কাস্টমার কেয়ার স্থাপিত হয়। একইভাবে ভাড়া করা স্পেসে আমিন বাজার ও সাভারে দুটি ওয়ার হাউজ চালু করে। কোম্পানিতে একপর্যায়ে প্রায় দুই হাজার ব্যবস্থাপনা স্টাফ ও ১৭০০ অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিলো। যা ব্যবসায়িক অবনতিতে বর্তমানে যথাক্রমে স্টাফ ১৩০০ জনে এবং অস্থায়ী পদে প্রায় ৫০০ জন কর্মচারীতে এসে দাঁড়িয়েছে।
কর্মচারীদের একপর্যায়ে মোট মাসিক বেতন বাবদ দেওয়া হতো প্রায় ৫ কোটি টাকা। যা বর্তমানে ১.৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তবে গত জুন থেকে অনেকের বেতন বকেয়া রয়েছে। রাসেল ও তার স্ত্রী পদাধিকারবলে নিজেরা মাসিক ৫ লাখ টাকা করে বেতন নেন। তারা কোম্পানির অর্থে ব্যক্তিগত ২টি দামি গাড়ি (রেঞ্চ রোভার ও অডি) ব্যবহার করেন।
ইভ্যালির সিইও দেশের বাইরে কোনও প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বা অর্থপাচার করেছেন কি না জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মঈন বলেন, দেশের বাইরে তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন অর্থলগ্নির জন্য। তবে এখনও তিনি কোনও প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বলে তথ্য দেননি। অর্থপাচার করেছেন কি না তা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করছে। তিনি অর্থপাচার করেছেন এমন তথ্যও তিনি র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানাননি।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেলকে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে ইভ্যালির দুই কর্ণধারকে নেওয়া হয় র্যাব সদর দপ্তরে। শুক্রবার দুপুরে তাদের প্রতারণার মামলায় গুলশান থানায় হস্তান্তর করে। এর আগে আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির একজন গ্রাহক মামলাটি দায়ের করেন।
এদিকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় ইভ্যালির সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমার তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শুক্রবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অপরদিকে, আস্থা রেখে পাশে থাকতে গ্রাহকদের আহ্বান জানিয়েছে ইভ্যালি। একইসঙ্গে বিনিয়োগ পাওয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে বলেও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ইভ্যালির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে রাসেলের মুক্তি চেয়ে আদালত প্রাঙ্গণেই বিক্ষোভ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কিছু গ্রাহক। এসময় প্রায় অর্ধশত যুবক একত্রিত হয়ে ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, রাসেল ভাইয়ের মুক্তি চাই’ বলে শ্লোগান দিতে থাকেন।
পরে শুক্রবার বিকালে রাজধানীর শাহাবাগে এক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ই-কমার্স বিজনেস ধ্বংস করতে রাসেলের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বিক্ষোভকারীদের।
বিক্ষোভে আসা রেজাউল রাজ নামের এক গ্রাহক জানান, গুলশান থানায় যিনি মামলা দিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গে সব রকমভাবেই যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাত্র তিন লাখ টাকার মামলা। আমরা সবাই মিলে তার ঐ টাকা দিয়ে দেবো।
অপরদিকে ইভ্যালির গ্রাহকরা যাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।