কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতি হচ্ছে জীবন্ত মাছ বিপণনের মূলমন্ত্র শহরে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফরমালিনমুক্ত জীবন্ত মাছের ক্রয়-বিক্রয়
মতিনুজ্জামান মিটু : একটা সময় ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে গেলেও এখন তা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। জীবন্ত মাছের বিকিকিনিতে বদলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মাছের বাজার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের প্রফেসর ড. ফৌজিয়া এদিব ফ্লোরা ও মৎস্য অধিদপ্তরের উল্লাপাড়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বায়েজিদ আলম জানান, মাছে ভাতে বাঙালি। খাবার টেবিলে হাত দিয়ে কাঁটা বেছে মাছ খাওয়া বাঙালির এমন বৈশিষ্ট্য যা মজ্জাগত এবং তা জীনগত বৈশিষ্টেও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। টাটকা মাছ বা জীবন্ত মাছ এদেশের সমাজের মানুষের কাছে বরাবরই সমাদৃত ও লোভনীয়। মাছকে জীবন্ত রেখে ক্রেতা আকর্ষন করার নেপথ্যে রয়েছে মাছ চাষিদের খুব সাধারণ কলাকৌশল ও গভীর আন্তরিকতা।
বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জেলা থেকে আনা জীবন্ত মাছ বিকিবিনি হচ্ছে। ২০০৭ সালে রাজশাহীর তানর উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুল মতিনের হাত ধরে ঢাকা মহানগরে সর্বপ্রথম শুরু হওয়া জীবন্ত মাছ বিক্রির এই পদ্ধতি। বর্তমানে এটি ভোক্তা সমাজে ব্যাপক সমাদৃত ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে রাজশাহী থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জীবন্ত মাছ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পরিবহন হয়ে আসছে। জীবন্ত কার্প জাতীয় মাছ পরিবহনে রাজশাহীর মাছ চাষিরা সফলতা দেখিয়েছে তেমনই শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। মাছ উৎপাদন ও জীবন্ত মাছ বাজারজাতকরণে দেশে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়ে উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহী।
কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতি হচ্ছে জীবন্ত মাছ বিপণনের মূলমন্ত্র। অল্প সময়ের মধ্যে মাছ অনেক বড় করার পদ্ধতিকে বলা হয়ে আসছে কার্প ফাটেনিং।
এই পদ্ধতিতে পুকুরের মাছ এক বছরেই বড় করা ৬ থেকে ৭ কেজি। ১৫ থেকে ১৬ মাসের মধ্যে ৮ থেকে ১০ কেজি। জীবন্ত মাছ বিপননের ক্ষেত্রে কার্প ফ্যাটেনিং কলাকৌশল বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এক্ষেত্রে বড় আকারের পোনা কম ঘনত্বে মজুদ, মান সম্পন্ন পর্যাপ্ত সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ, পুকুরের পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ যথাযথ বজায় রাখা, জৈব উপকরণ ব্যবহার, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করার কারণে জীবন্ত মাছকে নিরাপদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সর্বোপরি সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ফলে কম সময়ে বেশি ওজনের মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়ে আসছে। হেক্টর প্রতি ১৮৫০ থেকে ২২৫০টি গড়ে ৫০০ গ্রাম আকারের কার্প জাতীয় মাছের পোনা মজুদ করার মাধ্যমে বছরে ৯ থেকে ১০ টন মাছ উৎপাদন করা যায়।
এক্ষেত্রে রুই ও কাতলা মাছকে প্রধান প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জীবন্ত মাছ পরিবহনের আগে সাধারণত ট্যাংকে কন্ডিশনিং করা হয়। প্রতি ট্রাকে সাধারণত ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি মাছ পরিবহন করা হয়। জীবন্ত মাছ পরিবহনের বেশ কয়েকটি পর্যায় এবং মুক্ত ও বন্ধ প্রক্রিয়া প্রচলিত আছে। মূলত বড় আকৃতির মাছ (রুই ৫ থেকে ৬ কেজি, কাতলা ৭ থেকে ৮ কেজি) জীবন্ত পরিবহনে বেশি গুরুত্ব পায়। জীবন্ত মাছ পরিবহনে গুণগত মানসম্পন্ন পানি ও পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বল্প শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মাছ চাষিরা এক্ষত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে এ পদ্ধতিকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে আসছে।
রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প যত বড় হবে তত কদর বেশি। দামও বেশি। আর এ মাছ যদি জীবিত বা তাজা হয় তাহলেতো দাম আরও বেশি। সব মিলিয়ে জীবন্ত মাছের ব্যবসায় লাভ বেশি থাকায় স্থানীয় বেকার যুবকরা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রাজশাহী ও তার কাছের জেলা থেকে প্রতিদিন অন্তত ২৫০ ট্রাক মাছ ঢাকার বাজারে নেওয়া হয়ে আসছে।
রাজশাহীর কয়েকটি উপজেলা পর্যায়ে (পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা ও মোহনপুর) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় প্রতিবেদনে জানা যায়, জীবন্ত কার্প জাতীয় মাছ পরিবহনের ক্ষেত্রে (রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প ও মিরর কার্প) ছয় মাসে ২,৬৪,০১৬ কেজির বিপরীতে ৬,১৫,১৫,০০৪ টাকা শুধুমাত্র রাজধানীর বাজার থেকে আয় হয়। ২০১৫ সালের অন্য এক গবেষণায় রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নে ছয় মাসে রাজধানী শহরে গ্রাস কার্প ও তেলাপিয়াসহ কার্প জাতীয় মাছ হতে মোট ৪৬৪.৩০৭ টনের বিপরীতে আয় হয় ১০৫.১৩ লাখ টাকা।