ছয় প্রতিষ্ঠানের ৪৬৭ কোটি টাকা পাওনা নিয়ে শঙ্কায় গ্রাহকরা সাত প্রতিষ্ঠানের কাছে বীমা অর্থের দাবিতে এক বছরে ৩২ হাজার ৭৯৫ অভিযোগ
মো. আখতারুজ্জামান : দেশে বর্তমানে বেসরকারি জীবন বীমা কম্পানি রয়েছে ৩৫টি। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক সময়ে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাপ্ত বীমা দাবির অর্থের জন্য গত এক বছরে কমপক্ষে ৩২ হাজার ৭৯৫ অভিযোগ জমা পড়েছে। নিয়ম অনুযাই বীমার মেয়াদ শেষ হলে গ্রাহককে ৯০ দিনের মধ্যে তার অর্থ ফেরত দিতে হবে। নেই নিয়ম মানছে না বীমা কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি, এজেন্টের মাধ্যমে নানা রকমের হয়রানির শিকার হচ্ছে গ্রাহকরা। বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের সঙ্গে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মতবিনিময় সভায় দেশের বীমাখাতে বেশ কিছু দুর্বলতা উঠে আসে।
আইডিআর সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের বিপরীতে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দায় প্রায় ৪৬৭ কোটি টাকা। একটি প্রতিষ্ঠানের দায় জানা যায়নি। যেসব কম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ সেগুলো হচ্ছে ফারইস্ট ইসলামী ইনস্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স, পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্স, সানলাইফ ইনস্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার ইনস্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স ও হোমল্যান্ড ইনস্যুরেন্স। এর মধ্যে হোমল্যান্ডের দায় কত সেটা জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইডিআরএ’র কাছে যে পরিমাণ অভিযোগ আসে সেটা দিয়ে বাস্তবে বীমা খাতের বাজে চিত্র ধারণা করা ভুল হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়, বীমা দাবির অপরিশোধিত টাকার অঙ্কের হিসাব ও দাবির সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক বেশি। বীমার টাকা ফেরত পাননি এমন অনেক গ্রাহক আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেননি।
আইডিআরএ’র তথ্যমতে, যেসব কম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তারা অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে তাদের পরিচালন ব্যয় অনেক। সে কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করতে পারে না এবং এ কারণে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
কম্পানিগুলোর মধ্যে আইডিআরএ’র অভিযোগ সেলে ফারইস্ট ইসলামী ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নামে অভিযোগ পড়েছে ৫৫০টি। কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের অপরিশোধিত বীমা দাবির পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো। চলতি মাসে কম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে ঢাকা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় ড. মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে। তিনি বলেন, সব সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের কোনো রকমের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট নেই।
অপরিশোধিত বীমা দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, কাগজপত্র ও অডিট রিপোর্ট ছাড়া বলতে চাচ্ছি না, তবে বীমা দাবির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা থেকেও অনেক বেশি। কোম্পানিটির একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো বীমা দাবি অপরিশোধিত রয়েছে তাদের।
পদ্মা লাইফ ইনস্যুরেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা চার হাজার ৩৬৭টি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদ আলম সিদ্দিক বলেন, তাদের বীমা দাবি অপরিশোধিত ৩৫ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি গ্রাহকের অর্থ দ্রুত ফেরত দেওয়ার।
সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের অভিযোগ সংখ্যা এক হাজার ৬৫৭। বীমা দাবি অপরিশোধিত প্রায় ২১ কোটি। কম্পানিটি শেয়ারবাজারে জেড ক্যাটাগরিতে চলে যাওয়ার মতো। বিভিন্ন কায়দায় তারা টিকে আছে।
তবে আইডিআরএ’র অভিযোগ সেলে প্রায় পাঁচ হাজার ৩৪টি অভিযোগ পড়েছে ঐ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। গোল্ডেন লাইফের নামে অভিযোগের সংখ্যা দুই হাজার ৭৩ এবং অপরিশোধিত বীমা দাবির পরিমাণ প্রায় ৬৯ কোটি টাকা।
বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্সের অভিযোগের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪৬৬ এবং অপরিশোধিত বীমা দাবির পরিমাণ ২৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক আগেই প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, প্রশাসককে জমি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা দিতে বললেও এখন পর্যন্ত সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বীমা খাতের উন্নয়নে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন। এর মধ্যে রয়েছে, দেশের বীমা শিল্পের বিকাশে এবং উন্নয়নে অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন, এ লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; আন্তর্জাতিকভাবে বীমা শিল্পের যে বিকাশ হয়েছে সে সকল বিষয়সমূহ দেশের মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং বীমা শিল্পের সকলকে নিয়ে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে বীমা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হবে এবং বীমা ব্যবসা বৃদ্ধি এবং রি-ইন্স্যুরেন্স বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানেরও নির্দেশনা প্রদান করেন।