দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিবে মাতারবাড়ির দুই প্রকল্প
শোভন দত্ত : মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে নির্মাণ কাজকে কেন্দ্র করে দিন-রাতের নিবিড় কর্মযজ্ঞে এরইমধ্যে আমূল পাল্টে গেছে সমুদ্র তীরবর্তী এই অঞ্চলের যুগ যুগ ধরে দেখে আসা সেই দৃশ্যপট। দেশের দক্ষিণের এ দ্বীপ নিজে যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি তা দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা সরকারি নীতি নির্ধারকসহ বেসরকারি খাতের অনেকেরই। মাতারবাড়ির বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দরের দুই প্রকল্প অর্থনীতি খাতে নিয়ে আসবে আমুল পরিবর্তন।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নিয়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র করছে সেখানে। সঙ্গে কয়লা আমদানির জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজও চলছে।
প্রাথমিকভাবে বন্দরটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী এটিই হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর।
পাশাপাশি মাতারবাড়িকে গড়ে তোলা হবে বিদ্যুৎ ও শিল্পোৎপাদন এবং জ্বালানি আমদানির হাব হিসেবেও। সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় মিলে ধাপে ধাপে সেখানে বাস্তবায়ন করবে ৬৮টি প্রকল্প।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস আমদানির জন্য টার্মিনাল ছাড়াও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের বলেন, মাতারবাড়ি ঘিরে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় বলয় গড়ে তোলা হচ্ছে। মাতারবাড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে।
মাতারবাড়ির বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে দেশের কর্মসংস্থান বাড়বে। শিল্পোৎপাদন বাড়ার সঙ্গে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ পুরো প্রকল্প এলাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে হাজার হাজার বিঘা জমি বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিটার উঁচু করা হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকার এই প্রকল্পে বিদ্যুতকেন্দ্র ছাড়াও জেটিসহ আনুষঙ্গিক নিমার্ণ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাজারো দেশি-বিদেশি কর্মী।
মাতারবাড়ি প্রকল্পের পরিচলক আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্পের প্রায় ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইইনিট ও জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসতে পারবে বলে আশা করছি।
এখন মূলত বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ চলছে।
বয়লার, টারবাইন, চিমনিসহ বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য যা যা প্রয়োজন তারই কাজ চলছে। চারিদিকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য সাড়ে ১৮ মিটার গভীর ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা নৌ চ্যানেলের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
তবে নৌ চ্যানেলকে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত করার কাজের মধ্যে ২৫০ মিটার করা হয়েছে। বাকিটা চলমান রয়েছে, যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও ঢালঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে এ বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনার পর্যায় পেরিয়ে কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে।
ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তার কথা দীর্ঘদিন থেকে বল আসছেন সরকারি নীতিনির্ধারকসহ সব পক্ষই।
বর্তমান সরকার এই মহেশখালীর সোনাদিয়াতেই একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রকল্প অগ্রাধিকার তালিকায় রাখলেও সেটির এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য সেখানে একটি বন্দরের কথা সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হলেও পরে তা বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণের কাজে রূপ নেয়।
এ বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হলে ৫৯ ফুট গভীরতার চ্যানেল দিয়ে এই বন্দরে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে।
প্রকল্পের অন্যতম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানের তোশিবা করপোরেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এর আগে বলা হয়েছে, জাপানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে মাতারবাড়ির বিদ্যুতকেন্দ্রের সঙ্গে যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হবে, সেটি হবে জাপানের কাশিমা বন্দরের মত।
মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথম ভিড়েছিল পানামার পতাকাবাহী ‘ভেনাস ট্রায়াম্ফ’ নামের এ জাহাজ। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসে। ফাইল ছবিএখনকার গভীর এই সমুদ্র বন্দরে বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য ব্যবহার করা হবে দুটি জেটি। এছাড়া অন্যান্য বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের আরও এক ডজন জেটি করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের দুটি জেটি ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। একটা কয়লার জন্য, আরেকটটা তেলের।
চ্যানেল প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রথমে ছয়টি জেটি এবং পরে আরও ছয়টি জেটি নির্মাণ করবে।