১০ প্রতিষ্ঠানের প্রতারণায় সংকটে ই-কমার্স খাত
মো. আখতারুজ্জামান ও সুজন কৈরী : বেশি বেশি গ্রাহক টানতে অসম প্রতিযোগিতায় অনলাইনভিত্তি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এর ফাঁকে প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পরছে দেশের ই-কমার্স খাত। সবকিছু ঠিক থাকলেও অডিট রিপোর্ট রাখছে না এ খাতের কোম্পানিগুলো। এখন পর্যন্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ই-কমার্স কোম্পানির কাছে তথ্য চেয়েছে।
তারা অন্যান্য তথ্য দিতে পারলেও অডিট রিপোর্ট দিতে পারেনি কোনো কোম্পানি। অডিটরিপোর্ট না রাখার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ ও সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়গুলো বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সম্প্রতি ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পৃথক নিরীক্ষা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিড ডটকম ডটবিডি ও আলেশা মার্ট।
জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের পাওনা গড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। সেই হিসেবে আলোচ্য দশ ই-কমার্স কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের পাওনা ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ই-অরেঞ্জের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর ইভ্যালির কাছে ১ হাজার কোটি টাকা।
গ্রাহকদের এ বিশাল পাওনা পরিশোধ নিয়ে শষ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ই-অরেঞ্জ ও ইভ্যালির গ্রাহদের। কারণ ই-অরেঞ্জের মালিক কারাগারে। আর গ্রাহকের এক মামলায় গ্রাপ্তার হওয়া ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন পুলিশের ৩ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। তবে গ্রাহকদের প্রশ্ন মালিক যদি কারাগারে থাকে তাদের টাকা কিভাবে পাবে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালিকদের গ্রেপ্তার বা কোম্পানি বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। তারা বলছেন, কোম্পানিকে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ দিয়ে কিভাবে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়া যায় সেটাই হবে আসল সমাধান।
দিন যত যাচ্ছে ই-কমার্সের বিষয়ে সাধারণ গ্রাহদের মাঝে এক ধরণের বিরুপভাব তৈরি হচ্ছে। সেই চিত্র দেখা যায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষাণ অধিদপ্তরে ই-কমার্স খাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় দেখে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৬ হাজার ৩১৭ অভিযোগ এসেছে।
ই-অরেঞ্জের সাবেক ও বর্তমান মালিকরা গ্রেপ্তার আছেন। সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালিক গ্রেপ্তার হলে তখন আর কিছু করার থাকে না। ধামাকা ও ফালগুনী শপের মালিকদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারাও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে আছেন।
কিউকম ডটকমের বিজনেজ কমিউনিকেশন প্রধান হুমায়ুন কবির নিরব জানান, সরকার যে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করছে তাদের কাছে তথ্য চেয়েছে। আমরাও সেই তালিকায় রয়েছি। আমাদের কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে তার অধিকাংশই দিয়েছি। এখন অডিট রিপোর্ট বাকি রয়েছে। এর জন্য আমাদের আরও বেশকিছু দিন সময় লাগবে। কারণ হিসেবে তিনি জানান অর্থবছর শেষ হয়েছে মাত্র তিন মাস হতে চলছে।
গত বৃহস্পতিবার র্যাবের হাতে আটক হয় ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল গ্রেপ্তারের পর র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহক ও সাপ্লাইয়ারদের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে। রাসেল অবশ্য কয়েকদিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন, গ্রাহক ও সাপ্লাইয়ারদের কাছে তার প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৫৪৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে মাত্র ৩০ লাখ টাকা রয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর জানান, অনেক আগে থেকেই আমরা বলে আসছি দেশে ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় খাত। তবে এটা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারি তাহলে এই খাত ধ্বংসের মুখে পরবে। শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো।
তবে যা হবার তা হয়ে গেছে। আমরা মনে করি সাম্প্রতি সরকার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা এই খাতের জন্য ভালো হবে। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে গ্রাহকদের মাঝে এই খাতের বিষয়ে অনীহা তৈরি হয়েছে। আশা করি আসতে আসতে এটা চলে যাবে। সেক্ষেত্রে বেশ সময়ের প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, আমরা যারা উদ্যোক্তা আছি তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে গ্রাহকরা এখন আর আগাম পণ্যের দাম দিতে পারবে না। কারণ সরকার এ বিষয়ে পলিসি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে যে, আগাম টাকা নিলে ১০ দিনের মধ্যেই গ্রাহককে পণ্য দিতে হবে। তবে এটা কোম্পানিগুলো মানছে কিনা তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ আমাদের দেশে অনেক আইন রয়েছে যা অনেকেই না মেনে পার পেয়ে যায়।
ফাহিম মাশরুর আরও বলেন, ৮ থেকে ১০টি কোম্পানি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই যদি ভাবে যে ৮ থেকে ১০টি কোম্পানি মানেই ই-কমার্স। তাহলে ভুল হবে। আমাদের এখন কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা গ্রাহকের আস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। মূলত এরাই আমাদের ই-কমার্স খাতটা পরিচালনা করছে। তাদেরকে নিয়ে আমাদের পজেটিভ আলোচনা করা উচিৎ। কারা কি কি ভালো কাজ করছে সেটা নিয়েও বলা উচিত।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম শোভন জানান, আমরা ইতিমধ্যেই ১৬টি কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে নোটিশ দিয়েছি। এদের কেউ কেউ সময় চেয়েছে। যাদের জবাব সন্তোষজন নয় তাদের সদস্যপদ বাতিল করে দিবে।
তবে সদস্যপদ বাতিল বা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া সমস্যা সমাধান হতে পারে না। কারণ ব্যবসা বন্ধ থাকলে গ্রাহকদের পাওনা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। আমরা আমাদের সদস্যদের সদস্য পদ বাতিল করতে পারি। তবে এটা সমাধন নয়। সরকারের যেভাবে কন্ট্রোল করতে পারবে আমরা সমিতি হিসেবে সেইভাবে পারবো না।
তিনি বলেন, আমরা ইভ্যালির ব্যবসার শুরু থেকেই বলে আসছিলাম যে এভাবে ব্যবসা হয় না। তখন ইভ্যালির সিইও আমাদের বলেছিলো তাদের ১ হাজার ৫০০টি পণ্য রয়েছে এর মধ্য থেকে ১০-১৫টি পণ্যে ডিসকাউন্ট দিয়েছি যাতে আমার গ্রাহক বাড়ারে। গত বছর আমরা ইভ্যালির অবস্থা দেখে একটি পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট পাঠাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যেখাবে বলা হয়েছিলো যে ইভ্যালি যেভাবে ব্যবসা করছে তাতে প্রতিবছর কোম্পানিটি দেনা ৪০০ কোটি টাকা করে বাড়তে থাকবে।
এদিকে শনিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ এমন আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রতারণা করেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রির অফার দিয়ে যারা গ্রাহকদের পণ্য দেয় না, তারা মূলত প্রতারণা করছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এ সময় আরও জানান, এ ধরনের প্রতারকদের বেশি বেশি ধরা হলে ধীরে ধীরে প্রতারণা কমে আসবে। ভুক্তভোগীদের বলবো- লোভে না পড়ে সবকিছু বিচার বিবেচনা করে এসব বিষয়ে ইনভেস্ট করার জন্য।
তিনি বলেন, আমরা চাই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি দেশের মধ্যে প্রসারিত হোক এবং এর সুফল অনেকে পাচ্ছে। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও