মুদ্রা পাচার রোধে ‘শেল ব্যাংকে’র মাধ্যমে লেনদেন
সোহেল রহমান : দেশ থেকে মুদ্রা পাচার রোধে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে।
পাশাপাশি ওভার ও আন্ডার ইন্ভয়েসিং প্রতিরোধে কোনো তফসিলি ব্যাংক ‘শেল ব্যাংক’-এর সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে না। ইতিমধ্যে যেসব তফসিলি ব্যাংক ‘শেল ব্যাংক’-এর সঙ্গে লেনদেন করেছে এবং ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ অর্থ এ প্রক্রিয়ায় লেনদেন করেছে Ñ তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে ‘মানি-লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি’।
সম্প্রতি কমিটি’র ১৯তম সভায় এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আজিজুর রহমান।
জানা যায়, ‘শেল ব্যাংক’ হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এতে ব্যাংক গ্রাহকের নাম-ঠিকানা ছাড়া শুধু একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে হিসাব খুলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করা যায়। নাম-ঠিকানা থাকে না বলে এতে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। যে কারণে এর মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মানি লন্ডারিংয়ের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে শেল ব্যাংকিং নিষিদ্ধ।
সভায় মো. আজিজুর রহমান জানান, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার বিষয়ে গত ডিসেম্বরে অ্যাটর্নি জেনারেল-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত আন্ত:সংস্থা টাস্কফোর্স’-এর বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার মতে, শেল ব্যাংকিংগুলো চিহ্নিত এবং সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে সন্ত্রাসে অর্থায়ন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে।
বৈঠক সূত্রমতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার বেশি হচ্ছে। ব্যাংকগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর মূল্য সম্পর্কে অবগত নয়। এর বাইরে অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য বেশি দেখিয়ে ও রপ্তানির মূল্য কম দেখিয়ে বা দেশে না এনে অর্থ পাচার করা হচ্ছে।
ইতিপূর্বে এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি’র ক্ষেত্রে তদারকি আরও বাড়ানোর পাশাপাশি ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং ঠেকাতে ব্যাংকের নিজস্ব ডাটাবেজ তৈরি; কেন্দ্রীয় একটি ডাটাবেজ গড়ে তোলা এবং ভ্যাসেল ট্র্যাকিং ও কনটেইনার ট্র্যাকিং করার পরামর্শ দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’ (জিএফআই)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়। ট্রেড মিস-ইনভয়েসিং (আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬০ কোটি ডলার, ২০১৪ সালে ৬৩০ কোটি ডলার ও ২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি ডলার অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে গেছে।
জিএফআই-এর ‘ট্রেড-রিলেটেড ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ইন্ ১৩৫ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৮-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩ তম। বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ১০টি দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এসব দেশের তালিকায় রয়েছেÑকানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
সূত্র জানায়, ওয়ার্কিং কমিটি’র ১৯তম বৈঠকে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত গৃহীত কার্যক্রমগুলোর অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে বৈঠকে বলা হয় যে, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বিভিন্ন দেশ সাফল্য অর্জন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের নজীর যৎসামান্য।
পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রমগুলোর অগ্রগতির বিষয়ে বৈঠকে জানানো হয় যে, ইতোপূর্বে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ হতে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উপায়’ সংক্রান্ত এক বৈঠকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এ ধারাবাহিকতায় পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উপায় নির্ধারণে ‘বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার (দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ) মতামত নিয়ে একটি ‘গাইড-লাইন’ প্রণয়ন করেছে।
এ গাইড-লাইনের বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মতামত গ্রহণের পর পরবর্তী কার্যক্রম করা হবে বলে সভায় জানানো হয়।
সভায় আরও জানানো হয়, সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে তথ্য আদান-প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের অনুসৃত কৌশল পর্যালোচনা-পূর্বক একটি ‘কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করেছে ‘বিআইএফইউ’। একই সঙ্গে কৌশলপত্রে প্রস্তাবিত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার মতামত পাওয়ার পর এটি কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।