বাংলাদেশের জলসীমায় পরিত্যক্ত জালেই ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণির মৃত্যু
শোভন দত্ত : চলতি বছরের পহেলা আগস্ট চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে একটি ডলফিনের মরদেহ উদ্বার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির টিম। উদ্ধারকালে মৃত ডলফিনটির মুখে জড়ানো ছিল জাল। এরপর ময়নাতদন্ত করে জানা যায়, ‘মুখে জাল জড়িয়ে শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ায় ডলফিনটির মৃত্যু হয়েছে।’
আগস্টে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় মুখে জাল জড়ানো অবস্থায় বেশ কয়েকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। সাগরে জেলেদের ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জালের অংশ মুখে জড়িয়ে শ্বাসবন্ধ হয়ে ডলফিনগুলোর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে জুলাইয়ে ১০টি ও আগস্টে ১৩টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের জলসীমায় ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৫০টির মতো সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ডলফিন।
ডব্লিউসিএস-এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সমুদ্রে যেসব প্রাণির অকাল মৃত্যু হয়, এদের মধ্যে ডলফিনের সংখ্যা বেশি। এর মূল কারণ জেলেদের ফাঁস জাল। শুধুমাত্র এই জালেই ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণির মৃত্যু হয়। এছাড়া বিহুন্দি জাল ও সমুদ্রে চলন্ত ফিশিং বোটের আঘাতও ডলফিনের মৃত্যুর কারণ।’
অবহেলার কারণে জেলেদের মাছ ধরার যেসব জাল সাগরে ও সৈকতে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলোতে জড়িয়ে প্রতি বছর সাগরে ও নদীতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন- ডলফিন, হাঙর, সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি, কাঁকড়া ও সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘ভুতুড়ে জাল’ একটি বৈশ্বিক সমস্যা; তবে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর ও দেশের নদীগুলোতে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
জেলেরা বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পিঁপড়াও আমরা মারি না। কিন্তু অনেক সময় সমুদ্রে চলন্ত ফিশিং বোটের আঘাতে বা জেলেদের জালে পেঁচিয়ে ডলফিনের মৃত্যু হয়। ডলফিন জালে জড়িয়ে গেলে অনেক সময় জাল রক্ষা করার জন্য সেগুলোকে মেরে ফেলতে হয়, অথবা জাল কেটে দিতে হয়। পরে জাল ছাড়াতে না পেরে সাগরেই ওগুলোর মৃত্যু হয়।
ইকো ফিশ প্রকল্পের সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, সমুদ্রে যে পরিমাণ ডলফিন মারা যাচ্ছে, তার সামান্য অংশ আমাদের চোখে পড়ে। ৭১০ কিলোমিটার উপকূলের মাত্র ১০ কিলোমিটারের তথ্যই যদি এমন ভয়ানক হয়, তবে পুরো উপকূলে কোন পরিস্থিতি বিরাজ করতে পারে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এই হত্যাকা- বন্ধে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন আছে।
ডলফিনের পাখনা ও লেজ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়। তাই এক শ্রেণির জেলে সাগরে গিয়ে ডলফিন শিকার করেন। লেজ ও পাখনা রেখে দিয়ে মৃত ডলফিনের বাকি অংশ তারা নদীতে বা সাগরে ফেলে দেন।
কক্সবাজার উপকূলে জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য নেচার অফ বাংলাদেশের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের আগস্ট- এই এক বছরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ টেকনাফ, উখিয়া, মাতারবাড়ী, কুতুবদিয়া উপজেলা ও সেন্টমার্টিনের সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন অংশ থেকে মোট ২৫টি ডলফিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগের গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
ডব্লিউসিএস’র তথ্যমতে, বাংলাদেশে সাত জাতের ডলফিন ও এক জাতের পরপয়েস দেখা যায়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গাঙ্গেয় ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, হাম্পব্যাক ডলফিন, বটল নোজ ডলফিন ও ফিন লেস পরপয়েস। এরমধ্যে প্রকৃত মিঠাপানির নদীর ডলফিন মাত্র একটি, নাম গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক। অন্য ডলফিনগুলোর সবই সাগরের। গভীর সাগরে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে এগুলোর উপস্থিতি বেশ ভালো। এদের কোনো প্রকৃত শুমারি নেই। সুন্দরবন ও উপকূলীয় নোনাপানির নদীতে ডলফিনের আরেকটি প্রজাতি ইরাবতীর দেখা মেলে। ধারণা করা হয়, এখানে প্রায় সাত হাজার ইরাবতী ডলফিন রয়েছে।
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে বিচরণ আছে অতি বিপণ্ন জলজ প্রাণী গাঙ্গেয় (গাঙ্গেটিকা প্লাটানিস্টা) ডলফিন। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ও পানির লবণাক্ততার কারণে মা মাছের পাশাপাশি ডলফিনের আবাসস্থল এখন চরম হুমকির মুখে।
শুধু হালদা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোতে এটি একটি বিপণ্ন প্রজাতি। প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট ‘আইইউসিএন’ এ প্রজাতিকে মহাবিপন্ন হিসেবে লাল ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করেছে ২০১২ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির হিসাবে, হালদায় ২০১৮ সালে ১৬৭টি ডলফিনের অস্বিত্ব জানা গেলেও বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩৮-তে নেমে এসেছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ‘সি টু সোর্স: গঙ্গা’ অভিযানের অংশ হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক দল নিয়ে গঙ্গা নদীতে মাছ ধরার বর্জ্য জরিপ করে অধ্যাপক হিদার কোলডউয়ে নদীতে ও সাগরে ভুতুড়ে জাল সমস্যা সমাধানের পথ বের করেছেন। তিনি জানান, সাগর ও নদীতে মাছ ধরার যেসব পরিত্যক্ত জাল পাওয়া যায়, নাইনলের সেই জালগুলো মূল্যবান কার্পেট ও পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছেঁড়া জালের পুনর্ব্যবহারই ভুতুড়ে জাল সমস্যার একটি সমাধান হয়ে ওঠার জোরাল সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্র : টিবিএস বাংলা অনলাইন, বার্তা ২৪। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও